ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবি বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের তথ্য প্রকাশ্য

জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৬ জুন ২০১৯

জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধের নমুনায় মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া পাস্তুরিত অপাস্তুরিত দুধের নমুনায় ফরমালিন এবং ডিটারজেন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে রান্নায় ব্যবহৃত গুঁড়া মশলায় পাওয়া গেছে টেক্সটাইল রঙের উপস্থিতি। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তেল (পামওয়েল সরিষা এবং সয়াবিন), ঘি এবং ফ্রুট ড্রিঙ্কস মানও নিম্নমানের পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। এর আগে তারা বাজার থেকে এসব পণ্যের স্যাম্পল পরীক্ষা করে এই তথ্য প্রকাশ করল। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে ঢাবির ফার্মেসি লেকচার থিয়েটারে (পিএলটি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক এবং বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যে যত্রতত্রভাবে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহৃত হলে আমরা বাঁচতে পারব না। মরে যাব। মানুষ ও পশুর জন্য ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক সম্পূর্ণ আলাদা। গরুকে মানুষের এন্টিবায়োটিক দিলে, দুধ ও মাংসের মাধ্যমে তা আবার মানুষের শরীরেই প্রবেশ করে। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষয়। তিনি বলেন, পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও অপাস্তুরিত দুধের একটি নমুনাতে ফরমালিনও মিলেছে। অন্য একটিতে পাওয়া গেছে ডিটারজেন্ট। সংবাদ সম্মেলনে দুধ ছাড়াও ফ্রুট ড্রিঙ্কস, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, ঘি, গুঁড়া মশলা, শুকনা মরিচ, হলুদ, পাম অয়েল নিয়েও পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনা হলো- মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট ও ইগলু ম্যাঙ্গো। অপাস্তুরিত দুধের তিনটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে রাজধানীর পলাশী, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর বাজার থেকে। গবেষকরা জানান, বাজার থেকে সংগৃহীত আটটি ব্র্যান্ডের শুকনা মরিচের গুঁড়া মশলার নমুনায় ‘জলীয় উপাদান’ বিবেচনায় দুইটি নমুনা এবং ‘এসিড ইনসল্যুবল এ্যাশ’ বিবেচনায় আটটি নমুনার সবগুলোই বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এছাড়াও, আটটি ব্র্যান্ডের হলুদের গুঁড়া মশলার নমুনায় ‘জলীয় উপাদান’ এর হারে ছয়টি নমুনা বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সংগৃহীত গুঁড়া হলুদের নমুনাগুলোর বেশ কয়েকটিতে ‘মেটানিল ইয়েলো’ নামের টেক্সটাইল রঙের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া পাম অয়েলের ১০টি নমুনায় ‘স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু’, ‘পারক্সাইড ভ্যালু’, ‘ইনসল্যুবল ইমপিউরিটিজ’ থাকার হারে সবগুলোই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। সরিষার তেলের আটটি নমুনায় ‘স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু’ থাকার হারে তিনটি নমুনা, ‘পারক্সাইড ভ্যালু’ থাকার হারে চারটি নমুনা, ‘রিলেটিভ ডেনসিটি’ থাকার হারে চারটি নমুনা, ‘জলীয় উপাদান’ থাকার হারে সবগুলো নমুনাই মান উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত সয়াবিন তেলের আটটি নমুনায় ‘এসিড ভ্যালু’ থাকার হারে দুইটি নমুনা, ‘স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু’ থাকার হারে সাতটি নমুনা, ‘পারক্সাইড ভ্যালু’ থাকার হারে পাঁচটি নমুনা, ‘আয়োডিন ভ্যালু’ থাকার হারে পাঁচটি নমুনা, ‘রিলেটিভ ডেনসিটি’ থাকার হারে তিনটি নমুনা, ‘মেটাল কনটেন্ট’ থাকার হারে ছয়টি নমুনা, এবং ‘জলীয় উপাদান’ থাকার হারে সবগুলো নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। গবেষকরা জানান, ঘিয়ের সংগৃহীত আটটি নমুনায় ‘জলীয় উপাদান’ ও ‘আয়োডিন ভ্যালু’ ও ‘তিলের তেলের উপস্থিতি’ থাকার হারে সবগুলো নমুনা বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্রুট ড্রিঙ্কসের ১১ নমুনায় ‘টোটাল প্লেট কাউন্ট’ বিবেচনায় সাতটি নমুনা, ‘কলিফর্ম কাউন্ট’ বিবেচনায় তিনটি নমুনা মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া, সবগুলো নমুনাতেই বিএসটিআই কর্তৃক নিষিদ্ধ কৃত্রিম মিষ্টিকারক ‘সাইক্লোমেট’ এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উল্লেখ করা হয় জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক ‘লেভোফ্লক্সাসিন’ ও ‘সিপ্রোফ্লক্সাসিন’ এবং ছয়টিতে ‘এজিথ্রোমাইসিন’ এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত মিলিয়ে ১০টি নমুনার মধ্যে অপাস্তুরিত দুধের একটি নমুনায় ফরমালিন শনাক্ত হয়েছে। পাস্তুরিত দুধের নমুনাগুলোর মধ্যে তিনটিতে এবং অপাস্তুরিত দুধের নমুনার একটিতে ডিটারজেন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনায় ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ এর বিবেচনায় ছয়টি নমুনা; ‘সলিড নট ফ্যাট’ বিবেচনায় পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের ১০টি নমুনার সবগুলো; ‘এসিডিটি এনালাইসিস’ বিবেচনায় পাস্তুরিত দুধের একটি নমুনা ও অপাস্তুরিত দুধের তিনটি নমুনা; ‘টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট’-এ পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলো, ‘কলিফর্ম কাউন্ট’-এ পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার দুইটি, ‘স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ কাউন্ট’ হারে পাস্তুরিত দুধের পাঁচটি নমুনার পাঁচটি মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুধে ফ্যাট ইন মিল্ক থাকতে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার মধ্যে ছয়টিতেই এই পরিমাণে ফ্যাট ইন মিল্ক ছিল না। সলিড নট ফ্যাট থাকতে হবে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু এসব দুধের সবগুলোতেই কম ছিল। এসিডিটি এনালাইসিসে যত থাকার কথা পাস্তুরিত দুধের একটি ও অপাস্তুরিত দুধের তিনটি নমুনাতে এর পরিমাণ ছিল বেশি। টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্টও ছিল পাস্তুরিত দুধের সবগুলোতে স্বাভাবিকের বেশি। কলিফর্ম কাউন্ট পাস্তুরিত দুধের দু’টি নমুনাতে ছিল অনেক বেশি। আর স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ শূন্য থাকার কথা থাকলেও পাস্তুরিত দুধের পাঁচটিতে এর জীবাণুর উপস্থিতিতো ছিলই, এমনকি এর পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। অর্থাৎ বিএসটিআই মানদ- এসব দুধের সবগুলোই বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি জানান, ফ্রুট ড্রিঙ্কসের মধ্যে স্টারশিপ ম্যাঙ্গো ফ্রুট ড্রিঙ্ক, সেজান ম্যাঙ্গো ড্রিঙ্কস, প্রাণ ফ্রুটো, অরেঞ্জ, প্রাণ জুনিয়র ম্যাঙ্গো ফ্রুট ড্রিঙ্কস, লিটল ফ্রুটিকা ম্যাঙ্গো ফ্রুট ড্রিঙ্ক, সানড্রপ, চাবা রেড এ্যাপল, সানভাইটাল নেকটার ডি ম্যাঙ্গো, লোটে সুইডেন্ড এ্যাপল ড্রিঙ্ক ও ট্রপিকানা টুইস্টার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কৃত্রিম মিষ্টিকারক সাইক্লামেট ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ১১টি পণ্যের সবগুলোতেই এর ব্যবহার ছিল অতিমাত্রায়। সরিষার তেলের মধ্যে রূপচাঁদা, রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি, সুরেশ, ড্যানিশ ও বসুধার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরিষার তেলের স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, পারক্সাইড ভ্যালু, রিলেটিভ ডেনসিটির পরিমাণ ও জলীয় উপাদানের তারতম্য দেখা দেয়। এসব নমুনা মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। সয়াবিন তেলের মধ্যে রূপচাঁদা, ফ্রেশ, পুষ্টি, তীর, এসিআই পিওর, ভিওলা, মুসকান ও মিজান এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তেলের এসিড ভ্যালু, স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, পারক্সাইড ভ্যালু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আয়োডিন ভ্যালু আটটি নমুনার চারটিতে কম ও একটিতে বেশি পাওয়া গেছে। জলীয় উপাদান আটটি নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বাজারে প্রচলিত ৮টি ঘিয়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। এগুলো হলো- বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্কভিটা, মিল্কম্যান, সমির ও টিনে বিক্রি হওয়া নামবিহীন দু’টি নমুনা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ঘিয়ে জলীয় উপাদান ও আয়োডিন ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা রয়েছে এসব নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে। সংবাদ সম্মেলনে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পাস্তুরিত দুধে আশঙ্কাজনক কিছু পায়নি বিএসটিআই ॥ বাজারে থাকা ১৪ ব্র্যান্ডের ১৮টি পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে আশঙ্কাজনক কোন কিছুই পায়নি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। আদালতে সংস্থাটির জমা দেয়া প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। আদালতে শুনানিতে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল কাজী জিনাত হক। শুনানির শুরুতে হাইকোর্টে পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে ১৪ ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে আশঙ্কাজনক কিছু নেই বলে জানানো হয়। ব্র্যান্ডগুলো হলো পুরা, আয়রান, আড়ং ডেইরি, ফার্ম ফ্রেশ মিল্ক, মো, মিল্ক ভিটা, আফতাব, আল্ট্রা, তানিয়া (২০০ গ্রাম ও ৫০০ গ্রাম), ইগলু, প্রাণ মিল্ক, ডেইরি ফ্রেশ, মিল্ক ফ্রেশ এবং কাউহেড পিওর মিল্ক। পরে আদালত এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রম বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেন। এর আগে বাজারে পাওয়া যায় এমন পাস্তুরিত দুধ নিয়ে ২০১৮ সালের ১৭ মে ‘পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয় উল্লেখ করে পত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আদালতে নজরে আনা হলে আদালত এ বিষয়ে রিট আবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২০ মে হাইকোর্টের রিট দায়ের করেন আইনজীবী তানভির আহমেদ। ওই রিটের শুনানি নিয়ে বাজারে পাওয়া যায় এমন সব ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধের মান পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
×