ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি প্রার্থীর জয় ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হেরে যাওয়ার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২৬ জুন ২০১৯

বিএনপি প্রার্থীর জয় ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হেরে যাওয়ার নেপথ্যে

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার উপনির্বাচনের ফলাফলের পর সেই যে আড্ডা শুরু হয়েছে মঙ্গলবার তার রেশ কমেনি। আড্ডায় অংশগ্রহণকারী একজন বললেন, বাঙালী যে এত হুজুগে তার প্রমাণ এই আড্ডা। অপরজনের দ্রুত প্রতিউত্তর- তাহলে যিনি বলছেন তিনি কী। একেবারে যুৎসই উত্তর। তবে এই গপসপ বা আড্ডা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বের হয়ে এসেছে। নির্বাচনের পর সবচেয়ে বেশি কথা হয় ‘ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)’ নিয়ে। সকলের কথা এই যন্ত্র খুব ভাল। একই সঙ্গে সন্দেহ- সবই গোপন থাকলেও পরে কেউ ‘ইল মোটিভে’ অনৈতিকভাবে গোপন বিষয় জানতেও পারেন। তবে সাধারণত তা করা হয় না। তাদের কথা : ইভিএম ছিল বলে ভোট কেন্দ্রে কোন ধরনের গ-গোল হয়নি এবং কেউ তা করার চেষ্টাও করেনি। যুক্তি দিয়ে ক’জন বললেন, গ-গোল করবে কি করে! এটা তো আর জোর করে ব্যালটপেপার কেড়ে নিয়ে টপাটপ সিল দেয়া নয়। কারও মনে কিছু থেকেও থাকে তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি করবেটা কী। ইভিএমে যদি ভোট দিতে যায় তাহলে তো ভোটার নিয়ে যেতে হবে। কেউ যদি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করে তাহলে তো ভোটাররা যাবে না। না গেলে তো ভোটই বরবাদ। এসব কারণে কারও মনের গোপন ইচ্ছা থুবরে পড়েছে। তবে ইভিএম নিয়ে যতটা দ্রুত ফলাফল আশা করা হয়েছিল তা ঠিক থাকেনি। শুধু গণনা দ্রুত হয়ে প্রতিটি কেন্দ্রে আধাঘণ্টার মধ্যে ফলাফল দেয়া গেছে। তবে তা কন্ট্রোল রুমে ই-মেইলে প্রেরণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। দূর-দূরান্তের ভোট কেন্দ্রের এই ফলাফল ইভিএমসহ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত গাড়িতে (ভটভাটি) করে কন্ট্রোলরুমে আসতে অনেকটা সময় লাগে। সেখানে আবার ম্যানুয়ালে কাগজে কলমে লিখে নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে পাঠায় তিনি তা যাচাই বাছাই করে সিল স্বাক্ষর দেন। তারপর নির্বাচন কর্মকর্তারা কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি দেন।ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলার’ মতো অবস্থাই দাঁড়ায়। এই জটিলতা কাটালে ফল আরও দ্রুত হবে। তবে ইভিএম যে একটি উত্তম পন্থা তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বগুড়ায় যে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে তা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। যদিও ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ তারপরও উপনির্বাচনে এই ভোটও কম নয়। এদিন যে গরম ছিল তাতে অনেকেই ঘর থেকে বের হয়নি। আড্ডায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী এসএমটি জামান নিকেতা কেন এত কম ভোট (৩২ হাজার ২শ’ ৯৭) পেলেন এই নিয়ে বিশ্লেষণ হয়। নির্বাচনের আগে বলাবলি হয়েছিল, যদি ৩০ শতাংশ ভোটগ্রহণ হয় তাহলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হবে। সেখানে এই হেরে যাওয়া দুঃখজনক। কেউ তো আর বলতে পারবে না ভোটে কারচুপি হয়েছে। ইভিএম একেবারে সঠিক হিসাব দিয়েছে। যে বিষয়গুলো সামনে আসছে তা হলো ॥ আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবারই প্রথম জাতীয় নির্বাচন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নতুন মুখ। ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। তারপরও যত ভোট পেয়েছেন তাও কম নয়। সব সময়ই যে জিততে হবে তাও ঠিক নয়। অনেক সময় হেরে যাওয়াও আগামীর জয়ের সূচনা করে। উদাহারণ দেয়া হয় বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানকে। তিনি বিএনপির প্রার্থীর কাছে কয়েকবার হেরে গিয়ে এলাকার উন্নয়নে সম্পৃক্ত হয়ে, এলাকার মানুষকে ভালবাসা দিয়ে ভালবাসা নিয়ে নবম সাধারণ নির্বাচন থেকে আজ অবধি বিজয়ী হয়েছেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতা তাকে এগিয়ে নিয়েছে। কেউ তাকে হাত ধরে এগিয়ে দেয়নি। এ ক্ষেত্রে বগুড়া উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী (জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) তার পরিচিতি, সাংগঠনিক দক্ষতা, মানুষের মধ্যে দ্রুত মিশে যাওয়ার কারিশমার অভাব ভোটাররা বিবেচনায় এনেছেন। ভোটারদের মনে তিনি তেমন রেখাপাত করতে পারেননি। সর্বোপরি ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ভোটারদের উপস্থিতির হারও আশাব্যঞ্জক ছিল না। কর্মীদের তৎপরতা ছিল কম। কেন্দ্রে ভোটার আনতে কর্মীদের তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর দলে এখনও কেউ ঠিকমতো হাল ধরতে পারেননি। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ডাঃ মকবুল হোসেন। তিনি খুব সজ্জন ব্যক্তি। মমতাজ উদ্দিন ছিলেন দলের বটবৃক্ষ। তার ছায়াতলে বগুড়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ছিল মর্যাদার আসনে। বগুড়ার উপনির্বাচনে তার অনুপস্থিতি সকলেই অনুভব করেছে। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনু দলের সব নেতাকর্মীকে নিয়ে জনসংযোগ ও প্রচার মাঠে ছিলেন। তারপরও নবীণ প্রার্থী হেরে গেলেন। ভোটাররা প্রার্থীকে যতটা গ্রহণ করার কথা ছিল তা হয় তো হয়নি। কেন হয়নি বিষয়টি এখন প্রার্থীকেই (টি জামান নিকেতা) আত্মউপলব্ধিতে আনতে হবে কোথায় ভুল ছিল। উপনির্বাচনে ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি একটা বার্তা দেয় তা হলো : আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে হবে। বলা হয় বগুড়ার বেশিরভাগ ভোটার বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ প্রার্থী কে তা বিবেচনায় না এনে প্রতীককে (ধানের শীষ) ভোট দেয়। এই অবস্থাকে কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন নয় এমনটিও মনে করেন আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। বগুড়া-৬ (সদর) আসনকেও সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে নেয়ার সময় এসেছে।
×