ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান কি এবার টার্গেট হবে?

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৫ জুন ২০১৯

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান কি এবার টার্গেট হবে?

মধ্যপ্রাচ্যকে ভেঙ্গে খন্ডবিখন্ড করে, নতুন রূপে রূপ দিতে এ যুগের যুদ্ধবাজ কালাপাহাড় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টার মন্তব্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচীকে পারমাণবিক বোমা বানানোর গোপন কর্মকান্ড হিসেবে অভিহিত করা, একই সঙ্গে ইরানকে শত্রু গণ্য করা, মুসলিম দেশ সৌদি আরবের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে রণসাজে সজ্জিত করা বিশ্ববাসীকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করেছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র; যদিও হাস্যকর এ মিত্রতা। কারণ, সৌদি আরবকে সে সময়ের শক্তিমান ইরাক ও বর্তমানের নানা স্যাংশনে পরে কিছুটা নাজুক ইরানকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার গোপন লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। সৌদি সেই দেশ যে মুসলিম নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের জন্মশত্রু ইসরাইলকে, ইসরাইলের নিত্যদিনের ফিলিস্তিনী নিধনকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়! কাছেরই তুর্কীদের সম্ভাব্য মুসলিম দুনিয়ার উত্থান, তুর্কী কুর্দীদের কুর্দিস্তানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী শান্তি বিঘ্নকারী লড়াইকে জিইয়ে রাখা, আইএস নামক দানব দলের জন্ম দিয়ে তাদের লালন করে তাদের দ্বারা ইরাক-সিরিয়ায় এই বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অবিশ্বাস্য বর্বর পন্থায় যে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে তার ফলে শুধু যে ইরাক-সিরিয়ায় লাখ লাখ বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশু নিহত হয়েছে, তা নয়; সমস্ত প্রাচীন সভ্যতার স্মারক প্রাসাদ, মসজিদ, মন্দির, নানা স্থাপনা গুঁড়িয়ে সমান করে দেয়া হয়েছে। অথচ এর জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। সিআইএ মুসলিম জাতিকে দিয়ে প্রতিবেশী দেশের মুসলিম জাতি ধ্বংস, মুসলিম এবং মুসলিম জাতির জন্মের আগের মধ্যপ্রাচ্যের সুজলা-সুফলা রাজ্যগুলোতে আসিরীয়, সুমেরীয়, বেবিলনীয় যেসব অভাবিত উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেসব অমূল্য নিদর্শন গুঁড়িয়ে যেতে দেখে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জাতিগুলোর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং শিক্ষিত নাগরিক সমাজের বিস্ময়কর নীরবতা, প্রতিবাদহীনতা পুরো বিশ্বের জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সব শহরে লাখ লাখ নারী- পুরুষের প্রতিবাদী মিছিলের মধ্যে সৌদি আরবের বিপরীত অবস্থান এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল। ইরাক আগ্রাসনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের কাছে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র থাকার যে সব মিথ্যা ডসিয়ার তৈরি করে মিডিয়ায় উপস্থাপন করেছিল, সেসব মিথ্যায় অন্তত এশীয়-ইউরোপীয় সিভিল সোসাইটি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। সেটিই ইরাক, লিবিয়া ধ্বংস হওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রে ১/১১ সংঘটিত হবার পর প্রকাশ হয় যে, ওই অভিযোগ ছিল বানোয়াট ও মিথ্যা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল- মধ্যপ্রাচ্যের দুটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী, সে সময়ের সবল অর্থনীতি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা তৈরিকারী ইরাক ও লিবিয়ার সাদ্দাম হোসেন ও মুহাম্মদ গাদ্দাফীকে উৎখাত ও হত্যার মাধ্যমে আরবীয় শিয়া-সুন্নি, কুর্দী-হানাফি প্রভৃতি ধর্মীয় ও উপজাতির মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দু’দেশের তেলসম্পদ দখলে নেয়া। সে সময় মিথ্যা প্রচারের জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর দলের সঙ্গে সংযুক্ত সংবাদ তৈরি ও প্রচারের জন্য Embedded Journalism নামের এক কিম্ভূত হাঁসজারু শ্রেণীর চরিত্র ও মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার জন্ম দেয়া হয়। কি আশ্চর্য! দুনিয়ার মানুষের চোখের সামনে শক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ নেতা ও ব্রিটেনের মেরুদন্ডহীন প্রধানমন্ত্রী পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে এক উন্মত্ত ভাংচুরের ছেলে খেলায় মেতে উঠেছিল সেটি কিভাবে বিশ্বজগৎ নিষ্ক্রিয়ভাবে দেখেছিল, তা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে- এখন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ কর্মকর্তাদের একটি যুদ্ধ, সমরাস্ত্র যার প্রধান খাদ্য, সেই সঙ্গে নিরীহ, নিরস্ত্র নারী-পুরুষ ও শিশু, সেটির প্রয়োজন পড়েছে আমেরিকার অর্থনীতি ও গ্রামীণ বেকারদের কর্মসংস্থানের অবস্থা আশানুরূপ নয়, সে কারণে। শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে- ভারতের নির্বাচনের আগে- কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় ৪০ পুলিশের ওপর পাকিস্তানী সন্ত্রাসী দলের হামলা ও হত্যার ঘটনার পর মোদি কর্তৃক পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করার মধ্যে একটি মিল আছে বলে মনে হয়। যে হামলার কোন প্রমাণ ভারতীয় পক্ষ দেখাতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে। তেমন একটি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ইরানকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু করতে চায় মার্কিন যুদ্ধবাজ নেতারা। ইরানের তেল ক্রয়ে ভারতসহ কিছু দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মানতে দেখা যাচ্ছে কেন, এটিও একটি প্রশ্ন। যদিও ইরাক তার ওপর হামলার সময় শক্তিশালী বন্ধু পায়নি তখন। বর্তমানে শক্তিশালী রাশিয়া ও চীনকে ইরানের পাশে পাবে, সম্ভবত ইউরোপীয় পার্লামেন্টও ইরানের পরমাণু কার্যক্রম বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বলেই জানে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন কোন যুদ্ধে সমর্থন দেয়ার তাদের কথা নয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিলটি নাকচ করে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের খাসোগি হত্যার ওপর করা মন্তব্যগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে বা ইমিগ্রেশন, বর্ডারে দেয়াল তোলা, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে নিত্য পরিবর্তনশীল, কখনও নেতিবাচক, কখনও ইতিবাচক মন্তব্যের ফলে তাকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিমের চাইতে কম অস্বাভাবিক ও অপ্রকৃতিস্থ মনে হয় না। ওদিকে সৌদি আরব ইয়েমেনে বোমা হামলা করে প্রতিদিন শত শত বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশুর অকারণ মৃত্যু ঘটাচ্ছে। এ বিষয়ের প্রতি বিশ্বজনমতকে বিশেষ দৃষ্টিপাত করতে দেখা যাচ্ছে না। কেন এই উদাসীনতা, সংবেদনহীনতা, অজ্ঞতা অথবা আত্মস্বার্থ প্রেমী মানুষের নিষ্ক্রিয়তা? এই একই আত্মপ্রেম, উদাসীনতা, অজ্ঞতা, কল্যাণ ও শুভ বোধহীনতা যে পশুত্বকে প্রকাশ করে, সেই বোধহীনতাই প্রকাশ পায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য ঘোষিত জাতিসংঘের ‘ফান্ড’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে একক সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করে, অভিবাসীদের বহিষ্কার করার নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করে, ইউনেস্কো পরিচালনা ‘ফান্ড’ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে। অথচ, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা এসব ফান্ড থেকে স্বদেশের প্রত্যাহার চায়নি! এককভাবে একজন প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিশাল বড় একটি দুর্বলতা, যা তাকে ডিকটেটরের সমান স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। মার্কিন সুশীল সমাজ, শিক্ষক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী-তারা কখনও কি এ কথা ভাবেনি? একইভাবে, মিয়ানমারের সামরিক শাসক, বেসামরিক শাসক- আউন সান সুচি এগারো লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত করেছে। এমন ঘটনায় চীন ও রাশিয়া সেদেশের সমর্থক হয় কিভাবে? কিভাবে সম্ভব এই অবস্থানে থাকা, সেই সোভিয়েট রাশিয়া, যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী জনগণের মিত্র হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। কেন তারা আজ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার একটি জাতিগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করেছে- এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না। তাদের কোন্ স্বার্থসিদ্ধি করছে সেদেশের সেনাবাহিনী? জনগণের আদালতে একদিন মিয়ানমারের শাসকদের দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কল্যাণ ও শুভবোধ একদিন জয়ী হবে। তা না হলে এসব স্বার্থান্ধ মানুষের হাতে ধ্বংস হতে থাকা ধরিত্রীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। পৃথিবীজুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আশা করি অশুভকে বিতাড়িত করার লড়াই শুরু করবে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের বোমা হামলা এবং এক অন্যায্য লড়াই, যেখানে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যা হুতি বিদ্রোহ দমনেই হোক বা প্রেসিডেন্টের পক্ষেই হোক, কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, জঙ্গী-জিহাদী বিরোধী লড়াই আর কোন একটি দেশের শাসকের জনবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সে দেশের কোন জনগোষ্ঠীর অসন্তোষ নিশ্চয় একদিনে, আকস্মিকভাবে প্রকাশ পায়নি। জনঅসন্তোষের প্রতিবিধান শাসক দ্বারা না করা হলে, সে অসন্তোষ ক্রমে বড় বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং তা দ্রুত সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘ সত্তর/আশি বছর পেরিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনের দখলকৃত ভূমি ফেরত না দিয়ে গোলান মালভূমি, পশ্চিমপারে আরও ইসরাইলী বসতি স্থাপন করে চলেছে ইসরাইল। যে স্থানটি প্রতিদিন নিরীহ ফিলিস্তিনী শিশু, কিশোর, তরুণ হত্যার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যার জন্য ইসরাইল বা জাতিসংঘ বা পশ্চিমা বিশ্ব কেউই এর চিরস্থায়ী সমাধানে কোন সফল উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একটি ভাল উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি। নরওয়ে সরকারপ্রধানও একবার উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং, পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজকে সুইডেনের স্কুলছাত্রী গ্রেটার মতো সব সংঘর্ষ, যুদ্ধ, জলবায়ুর উষ্ণায়নের কারণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন শুরু করলে হয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলা যুদ্ধ, সংঘর্ষ, দখল, পৃথিবীর উষ্ণায়ন অর্থাৎ মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×