ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কালো সোনা সাদা করার ধুম

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৪ জুন ২০১৯

 কালো সোনা সাদা করার ধুম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত সোনা মেলায় ব্যাপক সাড়া মিলেছে। বিপুল উৎসাহ নিয়ে এতে অংশ নিয়েছেন অবৈধ সোনার মালিকরা। রাজধানীর অন্তত কয়েক শ’ ব্যবসায়ী কালো সোনা সাদা করেছেন রবিবার। এজন্য মাত্র মাসুল গুনতে হয়েছে ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা। নীতিমালা না থাকার কারণে এতদিন ধরে হিসাবের বাইরে থাকা স্বর্ণ এই মেলার মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আসবে বলে আশা করছেন সোনা ব্যবসায়ীরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) যৌথভাবে আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী এ মেলার। মেলার নাম দেয়া হয়েছে স্বর্ণ কর মেলা। রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এর উদ্বোধন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। আগামীকাল মঙ্গলবার শেষ হওয়া এ মেলা চলবে প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ঢাকা বিভাগীয় কর অঞ্চলগুলোতে মেলা চলবে তিন দিন, বাকি বিভাগীয় শহরে দুদিন মেলা চলবে। উদ্বোধনী ভাষণে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, তৈরি পোশাক ও চামড়া শিল্পের মতো যারা সোনার কাঁচামাল রফতানির উদ্দেশে আমদানি করবে তাদের বন্ড সুবিধা দেয়া হবে। যারা বন্ড সুবিধা পাবেন তাদের আমদানি করা সব সোনা রফতানি করতে হবে। বন্ড সুবিধায় আনা সোনা খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। সাধারণ মানুষ বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম স্বর্ণ আমদানি করতে পারবেন। এর চেয়ে বেশি আনলে তা বাজেয়াফত করা হবে। তিনি বলেন, সোনা ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঁচ লাখ টাকা নিতে বলেছি। আর এ লাইসেন্স তিন বছর পর পর নবায়নের জন্য এক লাখ টাকা নেয়ার কথা এনবিআর থেকে বলা হয়েছে। এটিই চূড়ান্ত হবে। তবে কার কাছে কী পরিমাণ সোনা আছে, তার ঘোষণা আগামী ৩০ জুনের মধ্যেই দিতে হবে। এর পর আর নাও থাকতে পারে এ সুযোগ। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ নীতিমালার চেষ্টা করে আসছিলেন। শুধু এই ব্যবসাটির পরিচ্ছন্ন নীতিমালা ছিল না। কোত্থেকে স্বর্ণ আসে এবং কোথায় যায়, এর প্রকাশ্য কোন ব্যাখ্যা কারও জানা ছিল না। বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই কয়েক কেজি করে স্বর্ণের চালান ধরা পড়ত। যেহেতু নীতিমালা ছিল না, তাই কার কাছে কী পরিমাণ স্বর্ণ আছে, তা এতদিন সঠিকভাবে কোন ঘোষণা কেউ দিতে পারেনি। যারা কর দেন, তারা টাকার অঙ্কে একটা কিছু ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। গত বছর অক্টোবরে স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, এই নীতিমালার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সরকার এটি চাপিয়ে দেয়নি। এনবিআর-ব্যবসায়ী মিলে এই নীতিমালা তৈরি করেছে। এখন থেকে স্বর্ণ লুকিয়ে রাখার সুযোগ থাকছে না। যাদের কাছে অতিরিক্ত সোনা আছে, সেগুলো ঘোষণার বাইরে থেকে গেলে তা ইএফডি বা ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসে ধরা পড়বে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই মেশিন সোনার দোকান ও হোটেল/ রেস্টুরেন্টে যাবে। সোনার বার আমদানিতে শুল্ক কমানোর বিষয়টি তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রফতানির উদ্দেশে স্বর্ণের কাঁচামাল আমদানি করলে বন্ড সুবিধা থাকবে। অপ্রদর্শিত সোনা ঘোষণার আওতায় আনতে গিয়ে নানা শঙ্কার পাশাপাশি কত দাম ধরা হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন অনেক ব্যবসায়ী। মেলার প্রাঙ্গণে এ নিয়ে কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে দেখা যায় তাদের। দীর্ঘদিন ধরে গচ্ছিত থাকা ওই সোনার ক্রয়মূল্য ২০ বছর আগেরটি ধরবেন, নাকি বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী হিসাব করবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের মালিক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা বলেন, তিনি তার কাছে থাকা প্রতিভরি সোনার দাম ৪২ হাজার টাকা ধরে কর পরিশোধ করেছেন। সোনার দাম কত ধরা হবে- জানতে চাইলে এনবিআরের কর অঞ্চল-১ এর কমিশনার নাহার ফেরদৌসী বলেন, দাম নির্ধারণের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের বিবেচনার ওপর। তবে বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কমিয়ে ধরে পরে বর্তমান বাজারমূল্যে বিক্রির সময় ব্যবসায়ীরা জটিলতায় পড়তে পারেন বলে সতর্ক করেন তিনি। লাভের অঙ্ক বড় হওয়ায় ভ্যাটের আকারও তখন বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। সরজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়- মেলায় ভরিপ্রতি ডায়মন্ড ৬ হাজার টাকা, স্বর্ণ এক হাজার টাকা ও রূপার জন্য ৫০ টাকা কর প্রদান করে অবৈধ সোনা, রূপা বৈধ করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া মেলায় সোনালী ও বেসিক ব্যাংকে বুথ রয়েছে। সেখানে কর পরিশোধ করলে সারচার্জ ফ্রি সেবা দেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে কর অঞ্চল ভিত্তিতে বিভিন্ন স্টল ভাগ করে দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তাদের অপ্রদর্শিত স্বর্ণ বৈধ করতে মেলায় এসেছেন। কিভাবে কি করতে হবে বিস্তারিত প্রক্রিয়া বুঝে নিচ্ছেন কর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এমনই একজন নিউমার্কেটের রোজা জুয়েলার্সের সোনা ব্যবসায়ী আবু নাসের মোঃ আবদুল্লাহ বলেন- অপ্রদর্শিত সোনা বৈধ করার মেলা দেশে এবারই প্রথম হচ্ছে। মেলার উদ্বোধন উপলক্ষে এসেছি। পাশাপাশি আমার প্রতিষ্ঠানে যে সোনা আছে তা কোন্ প্রক্রিয়ায় কর পরিশোধ করব তা জেনে নিচ্ছি। সোনার দাম নিয়ে একটি সমস্যা আছে। অর্থাৎ বৈধ করার সময় কোন্ মূল্য দেখাব। পূর্বের কেনা মূল্য নাকি বর্তমান বাজারমূল্য? আগের মূল্য দেখালে সোনা বাড়বে। আর বর্তমান মূল্য দেখালে টাকার পরিমাণ বাড়বে। তাতে করও বাড়বে। এ ছাড়া নতুন নীতিমালা হয়েছে। অনেক কিছুর সমস্যা আছে। তবে এখন যেহেতু বৈধ করার সুযোগ এসেছে- তাই কর দিয়ে বৈধ করব। আমি আজকে জানলাম আগামীকাল এসে কর দিয়ে স্বর্ণ ঘোষণা করব। কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে আসা এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গচ্ছিত সোনা ৫০ লাখ টাকা ধরে তিনি সর্বশেষ আয়কর দিয়েছিলেন। কিন্তু তার গচ্ছিত স্বর্ণ ৫০০ ভরির বেশি। ফলে এখন তিনি সব সোনা বৈধ করবেন, নাকি আংশিক বৈধ করবেন, তা বুঝতে পারছেন না। মেলায় গাজীপুর কর অঞ্চলের স্টলে দায়িত্বে থাকা প্রধান সহকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, এর আগে কখনও সোনা মেলা হয়নি। তাই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বিষয়ে বুঝতে আসছেন। কিভাবে কর পরিশোধ করে স্বর্ণ বৈধ করবে। আমরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছি। এনবিআর সদস্য কানন কুমার রায় বলেন, এসআরও ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের এসআরও হবে কিনা- তা আমি জানি না। তাই এ সময় অপ্রদর্শিত সোনা ঘোষণা দিয়ে বৈধ করবেন। আর এ সুযোগ নিয়ে যারা সোনা বৈধ করবেন না তাদের জন্য ভাল কোন বার্তা আমরা দিতে পারব না। ব্যবসায়ীরা আরও সময় চাইলে তা নাকচ করে একথা জানান তিনি। মেলায় প্রথম দিনে বিপুল সাড়া পড়েছে। আজ, আগামীকাল মেলা আরও জমবে বলে জানিয়েছেন বাজুসের সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার। তবে কি পরিমাণ কালো সোনা সাদা করা হয়েছে তা কৌশলগত কারণে আপাতত গোপন রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। শেষদিন তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কানন কুমার রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার, সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়ালাসহ স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও রাজস্ব কর্মকর্তারা।
×