ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন সরকারী কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ;###;চাকরির জন্য চাকরি নয়, দেশের মানুষকে ভালবেসে জনসেবার চিন্তা নিয়ে কাজ করতে হবে

আত্মবিশ্বাসী হতে হবে ॥ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলে চলবে না

প্রকাশিত: ১০:১৬, ২৪ জুন ২০১৯

আত্মবিশ্বাসী হতে হবে ॥ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলে চলবে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না ভুগে আত্মবিশ্বাসী হতে নতুন কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যেখানে যাবেন শুধু চাকরির জন্য চাকরি না, দেশের মানুষকে ভালবেসে জনসেবার চিন্তা নিয়ে কাজ করুন। কর্মক্ষেত্রে জনসেবা করা, দেশসেবা করা, দেশকে ভালবাসা, দেশের মানুষকে ভালবাসা- এই কথাগুলো মনে রাখতে হবে। মাঠ প্রশাসনে যারা কাজ করবেন ওখানকার মানুষের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের পথ বের করতে হবে। তারা যেন ন্যায়বিচার পায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শুধু গতানুগতিকভাবে দেশ চালালে চলবে না। দেশকে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন করে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত চলতে হবে। দেশে দারিদ্র্যের হার আমেরিকার চেয়েও কমিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যের হার আজকে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমার লক্ষ্য আছে দারিদ্র্যের হার আরও কমিয়ে আনার। আমেরিকায় দারিদ্র্যের হার বোধ হয় সতেরো কি আঠারো শতাংশ। যে করেই হোক তার (আমেরিকা) থেকে এক পার্সেন্ট কমালেও আমাকে কমাতে হবে। বাংলাদেশকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। এটাই চাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেটা মাথায় রেখেই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। রবিবার রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমিতে চলমান ১১০তম, ১১১তম এবং ১১২তম আইন ও প্রশাসন কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সেসব সমাধানের নির্দেশনাও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নতুন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রে সব থেকে বড় কথা আত্মবিশ্বাস। কোন একটা কাজ করতে গেলে কিভাবে করব, কিভাবে হবে, কিভাবে টাকা আসবে, কোত্থেকে টাকা আসবে- এত দুশ্চিন্তা না করে মনে রাখতে হবে এ কাজটা করতে হবে। কিভাবে করতে হবে সেটা নিজেই খুঁজে বের করতে হবে। নিজের ভেতর ইনোভেটিভ চিন্তা থাকতে হবে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলে চলবে না। মনে করতে হবে অবশ্যই পারব। সরকার প্রধান বলেন, যারা মাঠ প্রশাসনে কাজ করবেন ওখানকার মানুষের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। কারণ আমরা ঘোষণা দিয়েছি প্রত্যেকটা গ্রামের মানুষ শহরের সুযোগ পাবে। সেভাবে কিন্তু আমরা গ্রামকে গড়ে তুলতে চাই। সেভাবে কিন্ত আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তুলছি। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, খেয়াল রাখতে হবে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদক যেন আমাদের সমাজকে ধ্বংস করতে না পারে। প্রতিটি অর্থ জনগণের অর্থ এটা মাথায় রাখতে হবে। আমরা বেতন-ভাতা যা পাচ্ছি সেটা এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের অর্থ, এটা মাথায় রাখতে হবে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করা, তাদের উন্নতি করা এটাই আমাদের কর্তব্য। নবীন কর্মকর্তাদের সঠিক ইতিহাস জানার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিহাস জানতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরের পরে আমাদের কয়েকটা প্রজন্ম বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পারেনি। ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল, এটা একটা জাতির জন্য সবচেয়ে সর্বনাশের ব্যাপার। কারণ আমরা যদি বিজয়ের ইতিহাস জানতে না পারি, পরাজিতদের পদলেহন করতে থাকি আমরা তাহলে উঠে দাঁড়াব কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী গত ১০ বছরে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সফলতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। এটাই চাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। হতদরিদ্রের হার আমাদের ১১ শতাংশ। হতদরিদ্রদের জন্য সেখানে বিশাল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছি। সরকারী সহায়তা পেয়ে কেউ যেন কর্মবিমুখ না হয় সেভাবে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, সহায়তা এমনভাবে দিতে হবে যাতে একেবারে না খেয়ে থাকে, কিন্তু কর্মবিমুখ না হয়। না খেয়ে কষ্ট পাবে না কিন্তু কর্মবিমুখ হতে পারবে না। সবাইকে কাজ করতে হবে সেভাবে সবাইকে উৎসাহ দিতে হবে। আমাদের গৃহীত পদক্ষেপে আজকে আমরা দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলাদেশের অপরাজেয় যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে তা যেন থেমে না যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন বলেই আজকে সর্বক্ষেত্রে বাঙালীরাই স্থান করে নিতে পারছে, বাঙালীরা যে পারে সেটাই হচ্ছে বড় কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বাঙালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যে কারণে আপনারা দেখবেন আওয়ামী লীগ যখন সরকারে আসে তখন কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। জনপ্রশাসনের উন্নয়নে নেয়া সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটা তিনি স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। আর সে কারণেই আজ সব ক্ষেত্রে বাঙালীরা স্থান করে নিতে পারছে। এবার যখন আমি ওআইসির সম্মেলনে যাই, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও ঘরোয়াভাবে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, তারা ছোট বেলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় অনেককেই বলতে শুনেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কিছুই করতে পারবে না। এরপর তিনি জানতে চান, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কত, রিজার্ভ কত, বাজেট কত ইত্যাদি। উত্তর শুনে খুব অবাক হয়ে বললেন, বাংলাদেশ তো পাকিস্তানের চেয়েও অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এ কথা কিন্তু এখন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই বলে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কী হবে, তা নিয়ে আমাদের কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে। আমার বয়স এখন ৭২ বছর। ২০৪১ তো আমি দেখতে পারব না। কিন্তু আজকের এই প্রজন্ম (প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশে), এরাই তো আমার ওই ২০৪১-এর দেশ গড়ার কারিগর। ঠিক কি না? সবাই রাজি তো? সেভাবেই কিন্তু সবাইকে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মাথাপিছু আয়ের কথা তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। পঁচাত্তরের পর সেটা থাকেনি। কারণ নীতি। স্বাধীনতাবিরোধীরা তখন ক্ষমতায় এসেছিল। তারা চায়নি বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াক। আর আমরা স্বাধীনতা অর্জনকারী সংগঠন। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমরা যদি আর বেশি নাও এগোই, এখন যেভাবে আছি সেভাবেই যদি থাকি, তবু কিন্তু ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাব। কিন্তু আমাদের আরও বেশি সামনে যেতে হবে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের উন্নয়ন শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক না, আমাদের উন্নয়ন হবে দেশব্যাপী। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে। তবেই এটা আমরা অর্জন করতে পারব। প্রতিটি অঞ্চলের উন্নয়ন হবে। কাজেই অনুরোধ করব, যে যেখানে যাবেন, শুধু চাকরির জন্য চাকরি নয়, জনসেবা এবং দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসার কথা মাথায় রাখতে হবে। এই চিন্তা থেকেই আপনারা পারবেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এইটুকু বিশ্বাস করি। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ১১০তম, ১১১তম এবং ১১২তম আইন ও প্রশাসন কোর্সের প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে সনদ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান, জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমেদ, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর কাজী রওশন আক্তার প্রমুখ। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে রেক্টর এ্যাওয়ার্ড পাওয়া দুইজন শিক্ষার্থীও বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানে। ১১০তম কোর্স থেকে মোহাম্মদ মাহবুল্লাহ মজুমদার, ১১১তম কোর্স থেকে রঞ্জন চন্দ্র দে ও ১১২তম কোর্স থেকে মাতলুব আহমেদ অনিক রেক্টর এ্যাওয়ার্ড মেডেল ও সনদ লাভ করেন।
×