ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব ধরনের গাছ সবুজের মায়া মুগ্ধতা কাটে না

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২৪ জুন ২০১৯

সব ধরনের গাছ সবুজের মায়া  মুগ্ধতা কাটে না

মোরসালিন মিজান॥ বিশাল খোলা চত্বর। বাণিজ্যমেলার মাঠ নামেই বেশি পরিচিত। তবে এখন ঢুঁ মারলে মন ভরে যাবে। একদমই অন্য চেহারা। বৃক্ষ দিয়ে সাজানো। সব ধরনের বৃক্ষ। মৌসুমি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। কী যে ভাল লাগে! সবুজের এই সমারোহ অসহ্য গরম ভুলিয়ে দেয়। একটা সতেজ অনুভূতি হয়। হ্যাঁ, বৃক্ষমেলার কথা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শেরেবাংলা নগরে চলছে এই মেলা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আয়োজন। ভাল খবর এই যে, আয়োজনটি শুরুর দিন থেকেই জমজমাট। অঙ্গনটি বৃক্ষপ্রেমীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। গত কয়েকদিন মেলা ঘুরে দেখা যায়, এখানে প্রায় সব ধরনের গাছ আছে। আছে পছন্দ মতো চারা সংগ্রহের সুযোগ। তবে অন্যতম আকর্ষণ ফল ভর্তি গাছ। ড্রাম বা টবে বড় হতে থাকা গাছ ফলের ভারে যেন নুইয়ে পড়ছে। দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আমের মৌসুমে আমই বেশি চোখে পড়ল। একইভাবে ধরে আছে লটকন, জাম্বুরা, মাল্টা। কাঁঠাল, লিচু, কামরাঙ্গা, করমচা, জলপাই, আমড়াসহ প্রায় সব দেশী ফলের চারা পাওয়া যাচ্ছে। মেলায় আছে বিদেশী অনেক গাছ। হোসেন নার্সারির স্টলে বাইরে থেকে আনা ফলজ বৃক্ষের বড় সংগ্রহ। চারা ও গাছের নিচে নাম লিখে রাখায় চিনতে সুবিধা হচ্ছিল। ছোট্ট একটি গাছে দেখা হলো আলুবোখারা। সুন্দর ধরে আছে। রাম্বুটান ফলটি এখন সুপারশপে কিনতে পাওয়া যায়। এখানে আছে গাছসমেত। আছে ব্রেডফ্রুটের চারা। ফলটি দেখতে ছোট কাঁঠালের মতো। ডুরিয়ান ফলের গায়ের কাঁটাগুলো আরও উঁচু। পেয়ারার জাত পাওয়া গেল দুটি। স্ট্রবেরি পেয়ারা ও মাধুরি পেয়ারা। অন্যান্য ফলের চারার মধ্যে রয়েছে মিরাকেল, ম্যাঙ্গোস্ট্যান, এগফ্রুট, মেন্ডারিন কমলা, কাউ ফল, ব্ল্যাকবেরি, মিসরীয় ডুমুর ও লম্বা সফেদা। স্টল মালিক হোসেন বললেন, বাইরে যেসব ফল খুব জনপ্রিয় আমরা সেগুলো দেশে করার চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে সফলতাও অনেক। সাধারণ মানুষ ফল সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছে। চারার বিক্রিও ভাল বলে জানান তিনি। আঁখও বিদেশী। হিরা নার্সারি নামের একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল, বস্তায় মাটি ভরে রীতিমতো আঁখের বাগান করা হয়েছে। স্টলের দায়িত্বে থাকা আনোয়ারুল ইসলাম রাজু জানান, আঁখের এই জাত ব্রাজিল থেকে আনা হয়েছে। ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। দেশী আঁখের তুলনায় চার-পাঁচগুণ বেশি মিষ্টি। রসাল এবং নরম। আঁখসহ প্রতিটি বস্তার দাম ১২০০ টাকা। আলাদা করে নজর কেড়েছে সৌদি খেজুর। সৌদি খেজুর মানে, সৌদি আরব থেকে আনা জাত। ছোট বড় এবং মাঝারি সাইজের চারা ও গাছ দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন আব্দুল হালিম। তার প্রতিষ্ঠানের নামও সৌদি খেজুর নার্সারি। ড্রামে লাগানো চারাগুলো প্রায় গাছে পরিণত হয়েছে। দাম হাঁকা হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। পলিপ্যাকে আছে অপেক্ষাকৃত ছোট গাছ। দাম ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। এত দাম কেন? জানতে চাইলে হালিম বলেন, আমাদের দেশের মাটি খেজুর গাছের জন্য উপযোগী নয়। আমি নিজের মতো করে মাটি প্রস্তুত করে নিয়েছেন। যতœ আত্মিও করতে হয় প্রচুর। এসব কারণেই দাম বেশি। একটু লম্বা সময় পরিচর্চা করতে পারলে এই সব গাছ থেকে প্রচুর ফলন পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। মেলায় বনজ বৃক্ষের মধ্যে চোখে পড়ল পশুর, দেশী গাব, বকুল, সেগুন, গর্জন, মেহগনি, আকাশমণি, রেইন ট্রি, তেলশূড়, শিশু, লোহাকাঠ, চাপালিশসহ বেশ কিছু জাত। ঔষধি গাছের নিচে নাম লিখে দেয়া হয়েছে। এই যেমন: উলটচন্ডাল, আকন্দ, ফণীমনসা, নিম, অর্জুন, বাসক, হরীতকী, আমলকী, বহেড়া, কালো তুলসী, কাসুন্দি, লজ্জাবতী, শতমূল। আগর, আতর, চন্দন গাছের চারাও দেখা হলো মেলায়। চন্দনের আবার দুটি জাত। একটি শ্বেতচন্দন। অন্যটি রক্ত চন্দন। মসলা প্রজাতির গাছগুলোও বেশ কৌতূহলী করছে। দারুচিনি, আদা, পুদিনা, এলাচ কিংবা বিলাতি ধনেপাতার গাছ কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। তবে মেলার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ফুল। বর্ণিল একটি চেহারা দিয়েছে। মৌসুমি প্রায় সব ফুল ফুটে আছে এখানে। স্টলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বাতাসে ভেসে আসছিল তাজা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। কখনও বেলী, জুঁই। কখনওবা মধুমঞ্জরি লতার চেনা ঘ্রাণ। গন্ধরাজ দেখে তো স্থির থাকা গেল না। কতকাল পর প্রিয় ফুলের কাছে যাওয়া! নাকে শুকতেই অদ্ভুত সেই ঘ্রাণটা! আছে অসংখ্য জাতের গোলাপ। তবে ফয়সাল নার্সারিতে গিয়ে চোখ ছানাভরা। এখানে দেখা গেল, এক গাছেই চার রঙের চারটি গোলাপ ধরে আছে। ইউটিউবে আগে দেখা হয়েছিল বটে। মেলায় দেখা গেল প্রথমবার। স্টলের মালিক ফয়সাল চার রঙের গোলাপ চারার দাম একেক সময় একেকটা বলছিলেন। কারণ জানতে চাইলে হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, বিক্রি করতে চাইছি না আসলে! মেলায় দেখা হলো জারবেরা। ঢাকার সব দোকানেই বিক্রি হয়। মেটাল বায়োটিক নারুসারি নামের একটি স্টলে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার কয়েকটি গাছ দেখা গেল। জারবেরা ছাড়াও এখানে আছে মেলামপডিয়ামসহ কয়েকটি ফুল। স্টলের দায়িত্বে থাকা মাহবুব-ই-খোদার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এগুলো তাদের নিজস্ব ভ্যারাইটি। অর্কিডের আবার আলাদা কদর। ডানকান নামের একটি স্টল শুধুই অর্কিড দিয়ে সাজানো। বিক্রেতা অমল সাহা জানান, তাদের এখানে প্রায় ১৪ জাতের অর্কিড আছে। ১৪ জাত মানে ১৪টি রং। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন তারা। বর্তমানে সংগ্রহে আছে প্রায় ২ লাখ গাছ। দীপ্ত অর্কিডস এবং প্রমি গারর্ডেন নামের দুটি স্টলেও আছে বাহারি অর্কিড। গ্রীন শপার্স নামের একটি স্টলে পাওয়া যাচ্ছে ক্যাকটাসও। এমনকি মেলায় আছে মেহেদী পাতা। অল্প টাকায় গাছ কিনে বাড়িতে লাগানো যেতে পারে। মেলায় কৃত্তিম জলাশয় তৈরি করে সেখানে লিলি পদ্ম ইত্যাদি ফুল উপস্থাপন করা হচ্ছে। বৃক্ষমেলা থেকে চারা ও গাছ কেনার পাশাপাশি সব ধরনের জাত সম্পর্কে জানার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা করছে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। উদাহরণ হতে পারে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের বিশালাকার স্টলটি। এখানে আছে প্রায় ৭৭ প্রজাতির ফলজ, ১০১ প্রজাতির বনজ ও ১২৯ প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষের চারা। ২০ প্রজাতির অর্কিড, ২০ প্রজাতির ক্যাকটাস এবং ১৩০ প্রজাতির অর্নামেন্টাল গাছের চারা সম্পর্কে জানা যাচ্ছে এখান থেকে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের স্টল থেকে চার হাজারের বেশি স্পেসিস সম্পর্কে তথ্য দেয়া হচ্ছে। আয়োজকদের পক্ষে সহকারী বন সংরক্ষক খন্দকার মোঃ জাকারিয়া বলেন, শহুরে মানুষকে বৃক্ষের প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলতেই এই মেলার আয়োজন। এখানে দেশের প্রায় সব বৃক্ষ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। আছে চারা কেনার সুযোগ। শহরবাসীর প্রতি সুযোগটি কাজে লাগানোর আহ্বান জানান তিনি। বিপুল এ আয়োজন অনেকদিন চলবে। সময় করে ঘুরে আসুন। বৃক্ষের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিন। ভাল থাকুন।
×