ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরাঞ্চলে সবজি আবাদ বাড়ায় পাল্টে গেছে খাদ্যাভ্যাস

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২২ জুন ২০১৯

উত্তরাঞ্চলে সবজি আবাদ বাড়ায় পাল্টে গেছে খাদ্যাভ্যাস

সমুদ্র হক ॥ উত্তরাঞ্চলে এখন সবজি আবাদের অবারিত মাঠ। খাদ্যাভাস পরিবর্তনে জীবনমানের নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। ভর বছর নানা জাতের ধান, গম, পাট ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সবজির আবাদ বেড়েছে। কখনও জমিতে অন্য ফসলের সঙ্গে আইলের ওপর সবজি চাষ হচ্ছে। পুকুর ও জলাশয়ের চার ধারে, কৃষক বাড়ির উঠানে চাষ করছে সবজি। কোন জমি আর পড়ে থাকছে না। অধিক শাক সবজি ও এক কেজি ওজনের নিচে মাছ ‘এ্যান্টি এজিং’ (শারীরিক গঠনে বেশি বয়সেও কম মনে হওয়া) খাবার হিসেবে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। উত্তরবঙ্গের মানুষ ভেজিটারিয়ান হয়ে এ্যান্টি এজিংয়ের দিকেই যাচ্ছে। দেহে অধিক বয়সের ছাপ কমে গিয়ে তারুণ্যের আভা ঠিক থাকছে। সঙ্গে বাড়ছে আয়ু। এখন মৌসুমভিত্তিক সবজি আর নেই। সবজি ফলছে সকল মৌসুমে। কৃষি গবেষকগণ দেশীয় সবজিকে সকল মৌসুমের ফলন উপযোগী করেছেন। যোগ হয়েছে অতিথি (বিদেশী) সবজি। বীজ আসছে বিদেশ থেকে। মানুষ দেশী ও বিদেশী উভয় সবজি পাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ নগরীর অভিজাত হোটেলে দেশে উৎপাদিত বিদেশী সবজিও পাওয়া যাচ্ছে। আরেকদিকে আমিষ খাবার বিশেষ করে গোশত রান্না কমে গিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষ সবজিভুক (ভেজিটারিয়ান) হচ্ছে। কোলেস্টরেল মুক্ত খাদ্যাভাসে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। সবজি বিক্রি করে কৃষক গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। উত্তবঙ্গের উদ্বৃত্ত ধান বিদেশে রফতানি হচ্ছে। সম্পূরক আবাদগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে সকল ধরনের সবজি। একটা সময় যে কচু ঘেচু ওল দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতীকী খাবার ছিল তা এখন বাড়তি উৎপাদন হয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে। লোকজন কচু ঘেচুকে এখন পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি হিসেবে খায়। কচু ঘেচু এখন মহানগরীগুলোর পাঁচ তারকা খচিত (ফাইভ স্টার) হোটেলের ভিটামিন সমৃদ্ধ উন্নত খাবার। যা বিক্রি হয় ডলারের অঙ্কে। মিষ্টি কুমড়ো, কপি, শসা, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙ্গা, মূলা, গাজর, টমেটো, শিম, বড়বটি, লাউ, কুমড়ো, চাল কুমড়ো, ঢেঁড়শ, পটল, আলু সব ধরনের শাক কাঁচা কলার হাট এখন মহাসড়কের ধারে বসে। সবজি আবাদের অন্যতম অঞ্চল বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে মহাসড়কের ধার দিয়ে চন্ডিহারা হয়ে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বসে সবজির হাট। কাঁচা কলার জন্য খ্যাত এই এলাকা। প্রতিদিন পূর্বাঞ্চল থেকে ট্রাকের পর ট্রাক আসছে উত্তরাঞ্চলে। ফিরছে সবজি নিয়ে। যাচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রাম বড় নগরীর পাইকারি বাজারে। কিছু অংশ উড়োজাহাজের কার্গো ফ্রেইটে যাচ্ছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। সবজি আবাদের উর্বর ভূমি উত্তরবঙ্গে এত সবজি উৎপাদিত হওয়ায় মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে শক্ত আমিষ খাবার গোশত কমতে শুরু করেছে। মুরগি, খাসি, গরুর গোশতের দাম বেড়েছে। মানুষ শরীর ঠিক রাখতে সবজি দিয়ে নিত্য নতুন রেসিপি তৈরি করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলো সবজি দিয়ে সুস্বাদের খাবারের কত যে রেসিপি বানাচ্ছে। এগুলোও পৌঁছে যাচ্ছে গৃহিনীদের কাছে। তৈরি হচ্ছে সবজির বৈচিত্রের সুস্বাদের খাবার। মাছ খাদ্য তালিকায় থাকছে সপ্তাহে দুই একদিন। ছোট মাছ থাকছে বেশি। ক’জন প্রবীণ বললেন, ভেজিটারিয়ান হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের রোগ ব্যাধি অনেকটা কমে গিয়ে গড় আয়ু বাড়ছে। তবে শঙ্কার কথাও বলেছেন-সবজি আবাদে জমিতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক সবজির গুণাগুণ নষ্ট করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জরিপ অনুযায়ী গত দশ বছরে উত্তরবঙ্গে সবজি আবাদ জ্যামিতিক হারে বেড়ে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে অনেক সবজির হাইব্রিড জাত নেমেছে। গাঁজর টমেটো শিম বড়বটি করলা লাউ কুমড়ো চিচিঙ্গা ইত্যাদি বলতে গেলে ভর বছরই ফলে। সিজনের আলু আবাদও আর সিজনের মধ্যে থাকছে না। এর মধ্যে বিদেশী সবজির আবাদ শুরু হয়েছে। এ্যাসপ্যারাগাস, ক্যাপসিক্যাম, লেটুস পাতা, চায়নিজ পাতা, বিট রুট, বোকলি, রেড ক্যাবেজ, চায়নিজ ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিম, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, লেমন গ্রাস, শিমলা মরিচ, স্লারি পাতা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জ, গাবতলি, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট, শাজাহানপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে বিদেশী সবজির আবাদ বেড়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জের টেপাগাড়ি গ্রামের সবজি চাষী মিজানুর রহমান প্রায় ১৯ বছর আগে ঢাকায় খামারবাড়ীতে সবজি প্রদশর্নীতে গিয়ে ক্যাবেজ লেটুস পাতাসহ কয়েক জাতের সবজি চারা নিয়ে বগুড়া অঞ্চলের আবাদ শুরু করেন। গত কয়েকবছরে একের দেখাদেখি আরেকজন বিদেশী সবজি আবাদ করতে থাকে। যা চলমান। পার্শ¦বর্তী জেলা জয়পুরহাট নওগাঁ নাটোর পাবনা অঞ্চলে বিদেশী সবজি আবাদ শুরু হয়েছে। ফসলের বহুমুখীকরণ আওতায় দেশী বিদেশী সবজিও যোগ হয়েছে। এইসব সবজি ঢাকা, চট্টগ্রামের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে যাচ্ছে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকার মাঠ পর্যায়ে সবজি কেনার ট্রাক প্রবেশ করছে। পূর্বাঞ্চলের পাইকারি ক্রেতারা অনেক সময় কৃষকদের আগাম অর্থ দিয়ে সবজি আবাদ করিয়ে নিচ্ছে। যারা আগাম অর্থ পাচ্ছে বিপণনে (বিক্রি) তাদের ভাবনা থাকছে না। তবে যারা পূর্বাঞ্চলের পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না তাদের সবজি বেচতে হচ্ছে খোলাবাজারে। বাজারে চাহিদার তুলনায় সবজি বেশি উঠলে কখনও দাম নেমে যায়। তবে এই অবস্থা বেশি সময় থাকেও না। সবজি রফতানিকারকরা মাঠে নেমে বাকি সবজি কিনে নিয়ে যায়। অনেক রফতানিকারক বিশেষায়িত হিমাগারে রেখে ফুড প্রসেসিং করে বিক্রি করছে। এভাবে সবজি আবাদে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বদলে যাওয়া দৃশ্যপটে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে প্রবৃদ্ধি। একাধিক সূত্র জানায়, উত্তরবঙ্গের সবজি এখন আমেরিকা ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে জনিপ্রিয় খাবার। ওইসব দেশে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বসবাসকারী বাঙালীরা নিজেদের চেনা খাবার পাচ্ছে। বিদেশীরা আকৃষ্ট হচ্ছে। কৃষি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বললেন, উত্তরবঙ্গের মানুষ নিজেদের গরজেই ধান পাট গম ভুট্টার পাশাপশি সবজি আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গ্রামের গৃহস্থ ও কিষান বাড়ি আঙিনা ও ফেলে রাখা জমি এখন আর পড়ে থাকে না।
×