ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘সুরের আগুন ছড়িয়ে যাক সকল প্রাণে...’

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২২ জুন ২০১৯

 ‘সুরের আগুন ছড়িয়ে যাক সকল  প্রাণে...’

মনোয়ার হোসেন ॥ সুরের স্রোতধারায় ভেসে যায় অসুরের আগ্রাসন। অশুভকে হটিয়ে জেগে ওঠে মানবিক বোধ। শুক্রবার বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে সেই বোধটি যেন আরও বেশি শাণিত হলো। সকলের প্রাণে ছড়িয়ে শুভ চেতনাশ্রয়ী সুরের আগুন। এদিন সুরের আশ্রয়ে গানপ্রেমীরা খুঁজে নিয়েছে সুন্দরের পথরেখা। প্রাণে প্রাণে বয়ে গেয়েছে সুরের আলোকধারা। সঙ্গীতভিত্তিক নানা আয়োজনে মুখরিত হয়েছে রাজধানীর সংস্কতি অঙ্গন। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি থেকে শাহবাগের জাতীয় গণগ্রন্থাগার কিংবা ধানম-ির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে দেখা মিলেছে সঙ্গীতের সর্বজনীন আবহ। সঙ্গীত দিবসে নবীন-প্রবীণ থেকে প্রখ্যাত শিল্পীদের সম্মিলন ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে। মনমাতানো সঙ্গীতাসরে শ্রোতারা শুনেছে অর্ধশত শিল্পীর গান। বেজেছে হৃদয় উচাটন করা অর্কেস্ট্রার সুর। বাউলের একতারার শব্দধ্বনিতে অনুভূত হয়েছে আপন সংস্কৃতিক ঠিকানা। বাদ যায়নি পঞ্চকবির গান থেকে লালনগীতি। বিদেশী ভাষার গানে গানে ছিল সীমানা পেরুনোর আহ্বান। ‘সুরের আগুন ছড়িয়ে দেব সব প্রাণে’ প্রতিপাদ্যে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সঙ্গীতের সুরে। বড়দের সঙ্গে ছোটরা কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে ওঠেÑ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...। এরপর শ্রোতার হৃদয় রাঙায় অর্কেস্ট্রার অপূর্ব শব্দধ্বনি। প্রাচ্যের বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে একতালে বেজে ওঠে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র। ফুয়াদ নাসের বাবুর পরিচালনায় সেতার, তবলা, কি-বোর্ড, বাঁশি আর গিটারে অর্কেস্ট্রার অনবদ্য পরিবেশনাটি উপস্থাপন করে বাংলাদেশ মিউজিশিয়ানস ফাউন্ডেশন। এরপর অনুষ্ঠিত আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম ও দিনাত জাহান মুন্নী। এর আগে দিবসটি উপলক্ষে শিল্পকলা প্রাঙ্গণে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। কে এম খালিদ বলেন, এবার অর্ধশত শিল্পীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ আয়োজন। আগামীবার শত শিল্পীর অংশগ্রহণে সঙ্গীত দিবসের উৎসব হবে। সে সঙ্গে এ বছরের মধ্যে সারা দেশের শিল্পীদের ঢাকায় নিয়ে এসে একটি জাতীয় সম্মেলন ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনও করা হবে। সে সঙ্গে মুজিব বর্ষে নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের বিপুল অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা হবে। শিল্পকলা একাডেমি শিশু দলের গানের গানের সুরে শুরু হয় পরিবেশনা পর্ব। খুদে শিল্পীরা গেয়ে শোনায় লালন সাঁইয়ের গান ‘সত্য বল সুপথে চল’। ঢাকা সাংস্কৃতিক দল ও শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত দল পরিবেশন করে ‘ও আলোর পথযাত্রী’। উত্তরায়নের শিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয় ‘জাগ জাগরে জাগ সঙ্গীত’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা শুনিয়েছে ‘জয় হোক জয় হোক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা গেয়েছে ‘সবারে বাসরে ভাল, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে’। সরকারী সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করে ‘ধীরে সমীরে চঞ্চল নীড়ে’। একতারা হাতে সাদা পোশাকের শিল্পকলা একাডেমির বাউল দল গেয়ে শোনায় ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’। ইউসুফ, প্রিয়াংকা গোপ ও অনিমা মুক্তি গেয়ে শোনান ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’। স্বদেশের সঙ্গীত শেষে ছিল বিদেশী ভাষার গানের পালা। পুুলক বেলী আফরোজ ও পারভেজ গেয়েছে উর্দু গান ‘ও লাল মেরি’। কোনাল, রাফাত ও হৈমন্তী শুনিয়েছেন আরবি গান ‘বিন্তে মালাবিয়া’। প্রতীক, পুতুল ও দিনাত জাহান মুন্নীর কণ্ঠে শোনা গেছে চাইনিজ গান ‘নিউ আইন’। লুইপা, সজীব ও পিংকীর কণ্ঠে গীত হয় নেপালী ভাষার গান ‘টুন্নারা ডামপু’। রাশিয়ান ভাষায় রন্টি, শুভ ও স্মরণ গেয়ে শোনান ‘নাতাশা’। কনা, ইমরান ও মুহিন পরিবেশিত হিন্দি গানের শিরোনাম ছিল ‘কাভি কাভি’। আরমান মুসা, সাব্বির ও জয় শাহরিয়ার গেয়েছেন জনপ্রিয় ইংরেজী গান ‘সামারওয়াইন’। এছাড়া পাশাপাশি মেহরাব, আলিফ ও সুজন আরিফ স্প্যানিস ভাষায় এবং ইবরার টিপু, বিন্দুকনা ও শান জাপানিজ ভাষার গান শোনান। মৌটুসী, বাদশা বুলবুল, সিথি, প্রিয়াংকা বিশ্বাস ও ডলি শায়ন্তনী পরিবেশিত ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানের মাধ্যমে শেষ হয় আয়োজন। সঙ্গীত হোক বিশ্বজয়ের মন্ত্র প্রতিপাদ্যে বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের আয়োজন করে সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। দুই দিনব্যাপী এ সঙ্গীতসারের সূচনা হয় শুক্রবার বিকেলে। সুরে সুরে আলোড়িত হয়ে ওঠে উৎসব আঙিনা শাহবাগের সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তন। সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এর আগে বের হয় সঙ্গীতশিল্পী নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সম্মেলক সঙ্গীত, নৃত্য পরিবেশনা, বাউল গান, একক সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের সম্মিলনে সাজানো হয় প্রথম দিনের আয়োজন। অনুষ্ঠানে শিল্পী মিতা হককে সংবর্ধনা প্রদান এবং একুশে পদকপ্রাপ্তি উপলক্ষে লিয়াকত আলী লাকীকে সম্মাননা দেয়া হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ ভাষাসৈনিক ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান, গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুর¯্রষ্টা শেখ সাদী খান ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংগঠনের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শিল্পী তপন মাহমুদ। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় পরিবেশনা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অবধি নানা আঙ্গিকের সঙ্গীতের স্রোতধারায় সিক্ত হয় শ্রোতার অন্তর। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, সুরের ধারা, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, নিবেদন, রবিরাগ, বাঁশুরিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ, নির্ঝরিনী, গীত শতদল, গানের খেয়া, বেণুকা ললিতকলা একাডেমি, সঙ্গীত ভবন, মন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী, মহীরুহ, বাংলাদেশ একাডেমি, রবিরশ্মি, মন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বিশ্ববীণা, রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, নন্দন, গীতসত্র, লোকাঙ্গন, সপ্তরেখা শিল্পীগোষ্ঠী, হিন্দোল ললিতকলা একাডেমি, সারগাম ললিতকলা একাডেমি, প্রতীতি সঙ্গীত বিদ্যায়তন, পল্লী বাউল উন্নয়ন সংস্থা ও জাহানারা নিশি ফাউন্ডেশনের শিল্পীরা। সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে একক কণ্ঠে গান শোনান পাপিয়া সারোয়ার, আব্দুল ওয়াদুদ, আজিজুর রহমান তুহিন, সুজিত মোস্তফা, সন্দীপন, ঐশিকা নদী, সাজেদ আকবর, মহাদেব ঘোষ, পীযূষ বড়–য়া, টুম্পা সমাদ্দার, নারায়ণ চন্দ্র শীল, খন্দকার খায়রুজ্জামান, লীনা দাশ, রজত দত্ত ও সুরাইয়া পারভীন। বিশ্ব সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে ফেঁত-দো-লা-মিউজিক শীর্ষক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে ধানমন্ডির ফরাসী সাংস্কৃতিক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা। দুইটা থেকে রাত দশটা অবধি শ্রোতারা শুনেছে বাংলা, ইংরেজী ও ফরাসী ভাষার গান। সঙ্গে ছিল পিয়ানো, গিটার ও বাঁশির সুর মূর্ছনা। নানা ধারার সঙ্গীত সবার কাছে পৌঁছে দেয়া এবং সঙ্গীতের আশ্রয় মানবিক বন্ধন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে উন্মুক্ত পরিবেশে একের পর এক সঙ্গীত পরিবেশনই হচ্ছে ফেঁত-দো-লা-মিউজিকের মূল ধারণা। শ্রোতাদের জন্য উন্মুক্ত অনুষ্ঠানগুলোয় অর্কেস্ট্রা, অপেরা, কয়্যারের মতো সঙ্গীত ইনস্টিটিউটগুলো রাস্তা, পার্কসহ জাদুুঘর, রেলস্টেশন ও ঐতিহাসিক দুর্গের সামনে খোলা জায়গায় সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। এভাবেই সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে শহর আর আশপাশের এলাকাগুলোতে, বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে নতুন আর দক্ষ শিল্পীদের মধ্যে।
×