ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীতে পদ্মার পাড় দখলের হিড়িক

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২২ জুন ২০১৯

 রাজশাহীতে পদ্মার পাড় দখলের হিড়িক

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীবাসীর সেরা বিনোদনের ঠিকানা হচ্ছে পদ্মা নদীর পাড়। স্বাভাবিকভাবেই সারাক্ষণ এখানে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। এ সুযোগে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠছে অবৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের তৈরি করা বিনোদন কেন্দ্রের পাশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। সব মিলিয়ে শহরের বিপরীতে পদ্মার পাড়ে এ রকম শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নদীর পাড় দখলের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ বিআইডব্লিউটিআইএর নিয়ম অনুযায়ী নদীতীর থেকে ১৫০ মিটারের মধ্যে কেউ কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন প্রথম মেয়াদে মেয়র থাকার সময় নগরের বড়কুঠি বালুঘাট (পুরনো জাহাজঘাট) এলাকায় প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মা নদীর ধারের পরিত্যক্ত জায়গায় দৃষ্টিনন্দন বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলেন। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে এখন মানুষের ঢল নামে। এই বিনোদন কেন্দ্রের নাম দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজশাহীতে অবস্থানকারী নরওয়ের সাংবাদিক অডভার মুনসগাডের নামে ‘অডভার মুনসগাড পার্ক।’ এই পার্কের পূর্ব পাশে একটি ফুডকোর্ট এবং পশ্চিমদিকে ‘এম্ফি থিয়েটার’ করা হয়েছে। ফুডকোর্টের পাশে বেসরকারী উদ্যোগে আরও ছয়টি ফুডকোর্ট গড়ে উঠেছে। নদীর পাশে যাদের জমি রয়েছে, তারা নিজেদের জায়গায় একটি দোকান তৈরি করেছেন। পরে তারা নদীর পাড় বেঁধে তাদের প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত করেছেন। সেখানে দর্শনার্থীদের বসার জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই দোকানগুলো হচ্ছে রিভার ভিউ ফুড কর্নার, সিফাত ফুডস, রয়্যাল সি স্কয়ার, ফ্রেন্ডস ফাস্ট ফুড ও এন ফুড কর্নার। সন্ধ্যার পর এগুলোয় আলো ঝলমলে পরিবেশ তৈরি হয়। তরুণ-তরুণীরা ভিড় করেন সেখানে। সরেজমিন গিয়ে এন ফুড কর্নারের কর্মচারী মাসুদ রানার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, পেছনে দোকান মালিকের বাড়ি। যার যার বাড়ির সামনের সরকারী জায়গার ওপর তারই অধিকার থাকে। সেই হিসাবে মালিক জায়গাটি বেঁধে বসার উপযোগী করেছেন। কিন্তু মাঝখানে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা ঠিকই আছে। ফ্রেন্ডস ফাস্ট ফুডের স্বত্বাধিকারী আবদুস সালামের দাবি, এই জায়গায় তাদের ১০ বছরের পরিশ্রম রয়েছে। নিজে গায়ে খেটেছেন। শ্রমিক নিয়ে কাজ করেছেন। তারপর জায়গাটি বসার মতো হয়েছে। এখন নদীর ঢেউ এসে প্রথমে তাদের বাঁধা জায়গায় লাগবে। তার নিচে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধানো স্লোপিং। তাতে পানি আঘাত করতে পারছে না। তারাই জায়গাটি সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। সন্ধ্যায় একটা মনোরম পরিবেশ তৈরি হয়। তাতে ৮ থেকে ১০টা ছেলের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোথাও ময়লা আবর্জনা নেই। এখানে কেউ কোন অসামাজিক কাজ করতে পারে না। বিনোদন কেন্দ্রটির পশ্চিমদিকে যেখানে এম্ফি থিয়েটার রয়েছে। তার বিপরীতে এ রকম আরও অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সবাই নদীর ভেতরে বালুর বস্তা দিয়ে ঘিরে চত্বর তৈরি করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মিলন স্টোর, ফাতেমাতুজ্জোহরা চটপটি ও ফুচকা ঘর, সুইটি চটপটি, জুনায়েত চটপটি, ফুচকা হাউস, মা-মণি চটপটি, নাজিম উদ্দিন চটপটি এ্যান্ড ফুচকা, চটপটি ঘর, সিজার চটপটি ঘর, বিসমিল্লাহ মিনি চায়নিজসহ বেনামি আরও প্রতিষ্ঠান। এগুলোর নাম নেই। কিন্তু বাইরে সাজসজ্জা মনোরম। মালিকের খোঁজ করতেই পেছনের একটি ঢোপঘর থেকে একজন বৃদ্ধ হাঁক দিয়ে বললেন, তার প্রতিষ্ঠান তিনি ভেঙে নেবেন। তিনি বললেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মাটি কেটে তিনি জায়গা বেঁধেছেন। তার ছেলেসহ আরও কয়েকজন দোকানটি চালান। তার ভাষ্য, সবাই করেছেন, তাই তিনিও করেছেন। একইভাবে নগরের মুন্নুজান স্কুলের বিপরীতে রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চের পাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জাহাজঘাট, পঞ্চবটি, খোঁজাপুর, এলাকায় বাড়ির মালিকেরা তাদের বাড়ির পাশে নদীর পাড়ে পাকা স্থাপনা তৈরি করেছেন। বিজিবি নগরের শ্রীরামপুর এলাকায় নদীর জায়গা ইজারা নিয়ে স্থাপনা তৈরি করেছে। রাজশাহী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সাহিনুর আলম বলেন, নদীর মালিক তারা নন। মালিক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের নিয়ম অনুযায়ী নদী থেকে ১৫০ মিটার পর্যন্ত নদীর এলাকা থাকে। তবে রাজশাহীতে শুধু টি বাঁধের জায়গাটি পাউবোর অধিগ্রহণ করা। এর আশপাশে যারা দখল করেছেন, তাদের উচ্ছেদ করবেন। সব মিলিয়ে পদ্মা পাড়ের বিনোদনের জায়গাগুলোর এখন বেহাল দশা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারাচ্ছে সৌন্দর্য। কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে গরুর গোয়াল, কোথাও তুলে নেয়া হয়েছে চলার পথের টাইলস। দীর্ঘদিন ধরে এমন হাল হলেও সৌন্দর্য রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের। পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্য এভাবে নষ্ট করে ফেলায় ক্ষুব্ধ সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, ‘বিশে^র বিভিন্ন দেশে নদীকে ঘিরে বিনোদন স্পট গড়ে তোলা হয়েছে। আমিও আগের মেয়াদে তেমন উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার এসে দেখি সব নষ্ট হতে চলেছে। শীঘ্রই নদীর তীর থেকে গরুর গোয়াল উচ্ছেদের উদ্যোগ নেব। নগরীর মুন্নুজান স্কুলের সামনের পদ্মার পাড়টির ব্যবহার করা হচ্ছে গরু রাখার স্থান হিসেবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে গরু বেঁধে রাখা হচ্ছে। গোবরের গন্ধে ওই এলাকা দিয়ে হাঁটা দায় হয়ে পড়েছে। এমন হাল নগরীর পদ্মা পাড়ের প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। গরু রাখা ও গোয়ালঘর নির্মাণ করে চলছে পদ্মা পাড়ের জায়গা দখলের উৎসব। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক জানান, তারা বিষয়টি দেখেছেন। পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে শীঘ্রই তারা উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন।
×