ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বর্ষায় মাছ ধরার আনন্দ

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২২ জুন ২০১৯

 বর্ষায় মাছ ধরার আনন্দ

বর্ষায় মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মৌসুম শুরু হলেই গ্রামীণ জীবনে মাছ ধরার ধূম পড়ে। বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। ছেলে বুড়ো সকলের মধ্যে মাছ ধরার নেশা। বর্ষার আগে গ্রামে জাল বোনেন গৃহস্থ ও কিষানরা। জালের সুতার ধরন আলাদা। থিকনেস বেশি। কোন খুঁটি বা গাছের ডালের সঙ্গে সুতা এটে উঠানে বসে জাল বোনা। বুনতে এক ধরনের ছোট টাকু ব্যবহার করা হয়। জালের নিচে এক ধরনের লোহার কাঠি এঁটে দেয়া হয়। গ্রামের ভাষায় বলা হয় ‘ভর’। এই ভর জালকে ডুবিয়ে রাখে। মাছ এসে জালের ভিতরে ঘোরাঘুরির পর তোলার সময় বন্দী হয়ে পড়ে। একটি তউরা জাল বুনতে কখনও সময় নেয় এক মাস। কারণ দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে জাল বোনে তারা। ঘরের কোন এক কোনায় ঝুলে রাখা হয় তউরা জাল। বর্ষা শুরু হলে কেউ নৌকা করে নদীতে গিয়ে কেউ কাছের নদীতে বা কোন জলাশয়ে মাছ ধরার জন্য জাল ফেলে। এই জাল নিক্ষেপ করাও একটা শিল্প। জাল ছুড়ে দেয়ার সময় শরীরের ভর জালের সঙ্গে ব্যালান্স না হলে জালসহ পানিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বাম হাতের কনুইয়ের সঙ্গে জাল এটে নিয়ে ডান হাতে শক্তি প্রয়োগ করে লক্ষ্যে ছুড়ে দেয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা। তারপর জালবন্দী মাছ টেনে তোলা হয়। জেলে ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি জাল টেনে তোলার সময়ই বুঝতে পারে কী পরিমাণ মাছ উঠছে। বড় মাছ আছে কিনা। এই জাল ছাড়াও মাছ ধরার উপকরণের মধ্যে আছে ঠেলা জাল। কোন এলাকায় নাম জাকই। অতি চেনা উপকরণ দাড়কে। বাঁশের কাঠির তৈরি এক ধরনের খাঁচা। ¯্রােতের প্রতিকূলে বিশেষভাবে স্থাপন করার পর দাড়কের ছোট ছোট দরজা দিয়ে মাছ ঢুকে পড়ে আটকে যায়। পলই নামের গোলাকৃতির এক উপকরণ আছে। কাদা পানির মধ্যে আটকে ওপরের খোলা মুখে হাত ঢুকিয়ে কাঁদা ঘেঁটে মাছ তুলে আনা হয়। আরেক ধরনের জাল আছে। নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে বিশেষভাবে তৈরি খেয়া জাল লম্বা বাঁশের সঙ্গে ত্রিকোণভাবে এঁটে অনেকটা সময় নদীর পানিতে ডুবিয়ে রেখে টেনে তোলার পর অনেক মাছ ধরা পড়ে। নদীর নির্দিষ্ট অংশে ঘিরে দিয়ে মাছ ধরা হয় এক ধরনের বড় জাল দিয়ে। বগুড়ার যমুনাসহ দেশের বড় নদীগুলোতে এ ধরনের জালে মাছ ধরা হয। বর্তমানে জাল বাঁশ ড্রাম ইট দিয়ে নদীর মধ্যে খাঁচা বানিয়ে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। দেখে মনে হবে নদীর ভিতরে মশারি টাঙানো। জাল দিয়ে ঘিরে দেয়া একেকটি মিনি পুকুর। এই ধরনের প্রযুক্তি প্রথম শুরু হয় মাছের এলাকা চাঁদপুরে। বর্তমানে অনেক এলাকায় এভাবে নদীতে মাছ চাষ হচ্ছে। বর্ষায় মাছ ধরার জনপ্রিয় উপকরণ বড়শী। ছেলে বেলায় ছিপ ফেলে অর্থাৎ বড়শি দিয়ে মাছ ধরেনি এমন লোক কমই আছে। মাছ নিয়ে মজার অনেক কথা আছে। যেমন- সন্ধ্যায় কেউ ঘুমে ঢুলে পড়লে বলা হয় ট্যাংড়া মারছে। হলদে কালোয় ডোরাকাটা গচি মাছ দেখে বলা হয় বৌ-মাছ। মাছের অনেক প্রজাতি দিনে দিনে হারিয়েও যাচ্ছে। যমুনায় এক সময় পিয়ালী কাজলী মাছ মিলতো। এখন কম মেলে। এই বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, মিঠা পানির বিপন্নপ্রায় মাছগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায় পুকুর জলাশয় থেকে মাছ মেলে ৫৫ শতাংশ। নদী খাল বিল উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মেলে ২৮ শতাংশ। বর্ষা মৌসুমে মাছ মিলছে বেশি। জেলে সম্প্রদায় ছাড়াও শৌখিন মাছ শিকারিরা বর্ষায় মাছ ধরতে নামে। গ্রামীণ জীবনে মাছ ধরা নিয়ে বিশ^ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার পথের পাঁচালী ছবিতে শৈল্পিক দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন। যেখানে দেখা যায়- বয়স্ক ব্যক্তি। মাথায় টাক। পরনে হাতাওয়ালা গেঞ্জি। ছিপ ফেলে বসে আছেন জলাশয়ের ধারে। লেবুর রসের মতো বৃষ্টি। পাশেই মাছ ধরে রাখার খলই। নিমগ্ন দৃষ্টি কখন মাছ টোপ গিলবে। ছিপের কাঠি নিচে নেমে যাবে। তখনই টেনে তুলতে হবে। হঠাৎ বৃষ্টির একটি বড় ফোঁটা টাকে পড়ল। হাত দিয়ে দেখলেন বৃষ্টির জল। দ্রুত ছাতা মেললেন। বর্ষা মৌসুমে বাঙালীর জীবনে মাছ ধরাও যে কত রোমান্টিকতা বয়ে আনে তা বলে দেয় এই দৃশ্য। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×