ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভালবাসার বাবা

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২২ জুন ২০১৯

ভালবাসার বাবা

ছোট্ট মফস্বল শহরের ছিমছাম এলাকা। বড় রাস্তাটার শেষ মাথার দোতলা বাসাটায় থাকে রুম্পা আর ঝুম্পা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। রুম্পা আর ঝুম্পা দুই বছরের ছোট বড়। রুম্পা পড়ে ক্লাস সিক্সে, আর ঝুম্পা ফোরে। এই এলাকার আরেক জনপ্রিয় চরিত্র হচ্ছে শিউলি। শিউলির সত্যিকারের পরিচয় কেউ জানে না। কয়েক বছর আগে সে কীভাবে যেন এখানে এসে হাজির হয়েছে। কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে- তা সে নিজেও বলতে পারে না। তার বাবা-মা কেউ নেই। তার কোন বাড়িও নেই। সে কখনও চায়ের দোকানের ঝুপড়ির পেছনে ঘুমিয়ে থাকে, কোনদিন কারও বাসার সিঁড়ির নিচে। কেউ দুটো খেতে দিলে সে খায়, না দিলেও তার কোন আপত্তি নেই। টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। তার কখনও ক্ষুধা-তৃষ্ণা পায় বলে মনে হয় না। সবসময়ই ঠোঁটে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে সে ছুটে বেড়ায়। তবে রুম্পা-ঝুম্পা আর শিউলিদের এলাকার সবচেয়ে রহস্যময় মানুষ আনিস আহমেদ। ভদ্রলোক বয়স্ক। মেহেদি দেয়া চুল আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোককে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি। সবসময় ভ্রু কুঁচকেই থাকেন। তিনি থাকেন রুম্পা-ঝুম্পাদের ঠিক পাশের বাসাটায়। তবে রুম্পা-ঝুম্পাদের সঙ্গে কখনও ওনার কথা হয়নি। ভদ্রলোক কারও সঙ্গেই কথা বলেন না। তাঁর বাসার দরজা-জানালাগুলো সবসময় লাগানো থাকে। বাসার ভেতর কী আছে কেউ জানে না। এই ভদ্রলোক সপ্তাহে একদিন বাজার করতে বের হন। এর বাইরে তিনি কোথাও যান না। তাঁর বাসায়ও কেউ যায় না। এলাকার বড়দের মুখে ছোটরা শুনেছে, আনিস আহমেদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন, কলেজ পেরিয়েই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর ছেলেটার বয়স ছিল সাত-আট বছর। ছেলে আর স্ত্রীকে ঘরে রেখেই যুদ্ধে যান তিনি। আর তারপর পরিবারকে হারান। তাঁর পরিবারের সদস্যদের হানাদার বাহিনী মেরে ফেলেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে আনিস আহমেদ দেখেন, কেউ নেই। সবাই মারা গেছে। তারপর থেকে তিনি একাকী থাকতে শুরু করেন। কারো সঙ্গে আর কথা বলেন না। সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন। আনিস আহমেদকে সবাই ভয় পায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাঁকে রাস্তায় দেখলে ভয়ে দৌড়ে পালায়। কেউ তাঁর আশপাশে যায় না। সেদিন দুপুর পেরিয়ে বিকেল নামছে। রুম্পা আর ঝুম্পা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়ে নিচ থেকে শিউলির কণ্ঠ শোনা গেল। শিউলি বলল, খবর আছে, খবর! পুবপাশের মাঠে মেলা বসেছে। কীসের মেলা বলতে পারিনে, কিন্তু আমি দেখে এলাম বুঝলে, কত কী যে বসেছে! মাটির হাতি-ঘোড়া, পুতুল, কাঠের পুতুল, বেলুন-বাঁশি, খই-মুড়কি- কত কিছু! রুম্পা বলল, উহ শিউলি! এক নিঃশ্বাসে কত কথা যে বলিস! কিন্তু ঝুম্পা লাফিয়ে উঠে বলল, মাটির খেলনা? বেলুন-বাঁশি? আমার ওগুলো চাই আপু! আমাকে এনে দাও! ঝুম্পার চেঁচামেচি শুনে দোতলার বারান্দায় ওদের বাবা এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে? ঝুম্পা উপর থেকে বলল, মেলা, বাবা! মেলা! আমাকে খেলনা কিনে দাও! বাবা হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা, দেব। শিউলির মন খারাপ হয়ে গেল। তার তো একটা বাবা নেই। তাকে খেলনা কিনে দেয়ার কেউ নেই! অন্যের খেলনা দেখে আর মাঝে মধ্যে সেগুলো কেউ ধরতে দিলে সাবধানে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখেই তার দিন কেটে যায়। শিউলি মন খারাপ করে চলে এল সেখান থেকে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামার বেলায় শিউলি যখন চায়ের টংটার সামনে বসে আছে, তখন দেখল, রুম্পা আর ঝুম্পা মিলে রঙিন কাগজে মোড়া একটা সুন্দর প্যাকেট নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। শিউলি জিজ্ঞেস করল, এটা কী রুম্পা আপা? রুম্পা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, সসস! কাউকে বলবি না। এটা হচ্ছে বাবার জন্য উপহার। কাল বাবা দিবস তো, সেইজন্য উপহার। শিউলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা দিবস কী? রুম্পা এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারল না। একটু ভেবে বলল, যেই দিন বাবাদের গিফট দেয় ওইদিন হচ্ছে বাবা দিবস। শিউলির আবার মন খারাপ হয়ে গেল। তার তো বাবা নেই। তার গিফট দেয়ারও কেউ নেই! এমনিতে তার এমন লাগে না, কিন্তু আজ তার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। রুম্পা-ঝুম্পা চলে যাওয়ার পর আনমনেই অনেকক্ষণ কাঁদল সে। সারারাতও ঘুমাতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। সেদিন রাত পেরুল। সকালে শিউলি ছুটে গেল রাস্তার ওই মাথার কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে। তরতর করে গাছে উঠে এক থোকা ফুল পেড়ে আনল। তারপর সে অদ্ভুত একটা কাজ করে ফেলল। আনিস সাহেবের বাসার দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু তাই নয়, অসীম দুঃসাহস দেখিয়ে দরজায় নক করল। এমনিতে আনিস সাহেবকে দেখলে তার ভয়ে বুক ধড়ফড় শুরু হয়। কিন্তু আজকে তার একটুও ভয় লাগল না। সে পাথরের মতো দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রায় পনের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কেউ দরজা খুলল না। শিউলি দশমবারের মতো নক করল। এবার আনিস সাহেবের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে দরজায়?’ শিউলি উত্তর দিল না। দাঁড়িয়ে রইল। দরজা খুলে গেল। আনিস সাহেব শিউলিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে এসেছ কেন? কী চাই তোমার? শিউলি জানে না কী বলতে হবে। সে হাতের কৃষ্ণচূড়া ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল, বাবা দিবস! আনিস সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী? শিউলি বলল, আজকে বাবা দিবস। আপনি আমার বাবা হবেন? আনিস সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, তুমি কি পাগল, মেয়ে? আমি তোমার বাবার বাবার বয়সী। তোমার দাদার বয়সী। শিউলি বলল, শুনেছি মুক্তিযুদ্ধে যখন আপনার ছেলে মারা যায়, তখন সে আমার মতোই ছিল। তার মানে আপনার ছেলে তো আর বড় হয়নি। সে তো এখনও আপনার চোখে সেই তখনকার মতোই ছোট। তাহলে আমি আপনার মেয়ে হই না? বাবা দিবসে নাকি বাবাদের উপহার দিতে হয়। রুম্পা আপা, ঝুম্পা আপার বাবা আছে। ওরা ওদের বাবার জন্য উপহার আনে। ওদের বাবা ওদের মেলা থেকে মাটির খেলনা কিনে দেয়। আমার কেউ নেই! আমার বাবা নেই, আর আপনার ছেলে নেই। তাহলে আপনিই আমার বাবা, আমি আপনার মেয়ে। এটা আপনার উপহার। শিউলি হঠাৎ হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। আনিস সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে পানি চলে এল, প্রায় চল্লিশ বছর পর তিনি কাঁদলেন! শিউলিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, না মা, কে বলেছে তোর বাবা নেই? এই যে, আমিই তোর বাবা। তুই এখন থেকে আমার কাছেই থাকবি মা! আমি তোকে মেলায় নিয়ে যাব। মাটির খেলনা কিনে দেব। তুই আমাকেই উপহার দিবি। শিউলি অবাক হয়ে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যি বললেন? আনিস সাহেব তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বললেন, হ্যাঁ মা! একদম সত্যি বললাম। তুই আমার মেয়ে। তুই আমাকে ওভাবে ডাকবি না। বাবা বলবি, বাবা! শিউলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই কয়েকবার উচ্চারণ করল, বাবা! বাবা! বাবা! অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×