ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নটিংহ্যামে ওয়ার্নার ঝড়, সৌম্যর চমক

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ২১ জুন ২০১৯

 নটিংহ্যামে ওয়ার্নার ঝড়, সৌম্যর চমক

মিথুন আশরাফ ॥ বাংলাদেশকে নিয়ে সতর্ক অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ যে বিশ্বকাপে দুর্বার খেলছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নেমে, শুরুতে ঠিকই সতর্ক ছিল অসিরা। কিন্তু সাব্বির রহমান রুম্মন যখন ক্যাচ মিস করলেন ডেভিড ওয়ার্নারের, ১০ রানে ‘নতুন জীবন’ পেয়ে এমন ব্যাটিংই করে দেখালেন, ১৬৬ রান করেন এ ওপেনার। তার এ অসাধারণ ব্যাটিংয়ে রানের পাহাড়েও চাপা পড়ল বাংলাদেশ। ওয়ার্নারের সঙ্গে উসমান খাজা (৮৯) ও এ্যারন ফিঞ্চ (৫৩) যোগ্য সঙ্গ দিলে ৫ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩৮১ রান করল অস্ট্রেলিয়া। সৌম্য সরকার যদি বল হাতে ৩টি উইকেট তুলে না নিতেন তাহলে রান চার শ’ও হতে পারত! বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসে রেকর্ড রান করল অসিরা। এর আগে ২০১১ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ দলীয় ৩৬১ রান করেছিল অস্ট্রেলিয়া। এবার বিশ্বকাপে নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজে সেই রানকেও টপকে গেল তারা। অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে তখন ২৫ রান। ডেভিড ওয়ার্নার করেছেন ১০ রান। রান তোলায় ধুকতে থাকা ওয়ার্নারকে আউট করার সুযোগটি হাতছাড়া করেন দলের সেরা ফিল্ডার সাব্বির রহমান রুম্মন। মাশরাফি বিন মর্তুজার করা পঞ্চম ওভারের শেষ বলে কাট করতে চেয়েও পারেননি ওয়ার্নার। অফ স্টাম্পের বেশ বাইরের বলটি ঠিকমতো কাট হয়নি। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে থাকা সাব্বিরের হাতের কাছে যায় বলটি। একটু নিচু হয়ে যায়। কিন্তু সেরা ফিল্ডারদেরতো এসব ক্যাচ অনায়াসেই ধরতে হয়। বলে হাতের ছোঁয়াও লাগে। কিন্তু তা ফসকেও যায়। সাব্বির ক্যাচটি ধরতে পারেননি। এবার বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলার সুযোগ পেয়েই এমন এক ব্যাটসম্যানকে ‘নতুন জীবন’ দিলেন সাব্বির, যিনি কতটা ভয়ঙ্কর তা সবারই জানা। ‘ক্যাচ মিস, মানে ম্যাচ মিস’। কথাতেই আছে। তার নিশ্চয়তা ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিলবে না। তবে সাব্বিরের এই ক্যাচ মিসে বাংলাদেশ যে ভালভাবেই ভুগল, তাতো ওয়ার্নারের স্কোরেই প্রমাণ। ওয়ার্নার শেষ পর্যন্ত ১৪৭ বলে ১৪ চার ও ৫ ছক্কায় ১৬৬ রান করেন। অস্ট্রেলিয়া যে রান করল তা টপকে জেতাওতো কঠিনই! একটি করে ম্যাচ গেছে। রুবেল হোসেনকে খেলানোর দাবি জোরালো হয়েছে। কিন্তু একাদশে সুযোগ পাচ্ছিলেন না এ পেসার। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুযোগ মিলে। তাও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পিঠে চোট পেয়েছেন, তাতে রুবেলের একাদশে সুযোগ মিলে। কিন্তু রুবেল ৯ ওভারে ৮৩ রান দিলেন। তাকে নিয়ে যে এত আলোচনা, সব নিমিষেই থেমে যায়। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কত চিন্তার কথা শোনা গেছে। অসিরাই সেই ইঙ্গিত দেন। কিন্তু সাকিবকে (৬ ওভারে ৫০ রান দেন) এমনভাবে খেলেন অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানরা, চিন্তার কোন আলামতই মিলল না। বাংলাদেশের বিগ হিটার যে ক্রিকেটারদের ধরা হয়, সাব্বির তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনিও একাদশে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। অবশেষে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের কাঁধে চোট থাকায় সাব্বিরও খেলার সুযোগ পান। কিন্তু শুরুতেই সাব্বির ক্যাচ মিস করেন ওয়ার্নারের। আর তাতে করে দলও বিপত্তিতে পড়ে। এ্যারন ফিঞ্চ ও ওয়ার্নার মিলে এতটাই সাবলীলভাবে ব্যাটিং করেন, উইকেটে আঁকড়ে থাকেন। আবার স্কোরবোর্ডে রানও জমা করতে থাকেন। শুরুতে একটু ধীরে খেলে এগিয়ে যান। কিন্তু যতই ওভার যেতে থাকে, তাদের রানে গতিও বাড়তে থাকে। ১৭ ওভারে গিয়ে ১০০ রান স্কোরবোর্ডে জমা হয়ে যায়। দুইজন মিলে শতরানের জুটি গড়ার সঙ্গে আরও এগিয়ে যেতে থাকেন। যখন দলের রান ১২১ হয় তখন দলের ষষ্ঠ বোলার হিসেবে নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করে এবার হাফ সেঞ্চুরি করা ফিঞ্চকে (৫১ বলে ৫৩ রান) আউট করে দেন সৌম্য সরকার। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটি লাফিয়ে ওঠে। চমকে গিয়ে ব্যাটের ছোঁয়া লাগান ফিঞ্চ। শর্ট থার্ডম্যানে থাকা রুবেলের হাতে গিয়ে জমে বল। অস্ট্রেলিয়ার শতরানের ওপেনিং জুটি ভেঙ্গে যায়। তবে সাকিবকে হটিয়ে ততক্ষণে ফিঞ্চ বিশ্বকাপের সেরা রান সংগ্রাহক হয়ে যান। ফিঞ্চকে আউট করা বাংলাদেশ শিবিরেও খানিক স্বস্তি ফিরে। সেই স্বস্তি অস্বস্তিতে পরিণত হতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। উসমান খাজা ব্যাট হাতে নেমেও যে দুর্বার হয়ে ওঠেন। ওয়ার্নারের সঙ্গে তিনিও রানের চাকা সচল রেখে এগিয়ে চলেন। ৩৫তম ওভারে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া স্কোরবোর্ডে ২০০ রানও জমা হয়ে যায়। এর আগেই ওয়ার্নার সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে যান। সাকিব আল হাসানের করা ৩৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের ১৬তম ও এবার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে ফেলেন ওয়ার্নার। ৫৫ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার পর ১১০ বলে গিয়ে সেঞ্চুরি করেন। বল টেম্পারিংয়ের দায়ে এক বছর নিষিদ্ধ থাকার পর বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই কি দুর্বার ওয়ার্নার। ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম খেলেন। সেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। এবার বিশ্বকাপে ছয় ম্যাচের মধ্যে দুটি ম্যাচে শুধু পঞ্চাশ উর্ধ রান করতে পারেননি। ওয়ার্নারের সামনে সেঞ্চুরি করার দিক দিয়ে এখন শুধু অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মার্ক ওয়াহ (১৮ সেঞ্চুরি) ও রিকি পন্টিং (২৯ সেঞ্চুরি) আছেন। এবার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তালিকায় ফিঞ্চের এক নম্বর জায়গাটি খুব বেশিক্ষণ আবার টিকেনি। প্রায় ২৪ ওভার টিকেছে। টিকতে দেননি ওয়ার্নার। এবার বিশ্বকাপে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে (৪৪৭ রান) ৪০০ রান করেন। দলের যখন ৩১৩ রান, খাজার সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ১৯২ রানের জুটি গড়েন, তখনই ওয়ার্নার আউট হন। সৌম্যই আবার উইকেট নেন। থার্ডম্যানে রুবেলই ধরেন ক্যাচ। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথমবার সেঞ্চুরি করেন ওয়ার্নার। সেটি আবার দেড় শ’ রানের ইনিংস হয়ে যায়। এবার বিশ্বকাপে আবার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরও (১৬৬) করেন ওয়ার্নার। ইংল্যান্ডের জেসন রয় (১৫৩ রান, বাংলাদেশের বিপক্ষে) ও এ্যারন ফিঞ্চ (১৫৩ রান, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে) এবার বিশ্বকাপে ওয়ার্নারের আগে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর করেছিলেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরটিও ওয়ার্নারের। এর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে কোন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করতে পারেননি। ওয়ার্নার করে দেখালেন। ব্যাটিংয়ের জন্য নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজ বৃহস্পতিবার আদর্শ উইকেট। তা ভালভাবেই বুঝতে পেরে টস জিতে আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক ফিঞ্চ। অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানরাও ফিঞ্চের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করেন। ওয়ার্নার ও ফিঞ্চ শুরুটা করেন। খাজা এসে একই পথে হাঁটেন। ওয়ার্নারের সঙ্গে ১৯২ রানের জুটি গড়েন। তা এবার বিশ্বকাপে যে কোন দলের সেরা জুটিও হয়ে গেছে। এ জুটি হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে ৩০০ রান জমা হয়ে যায়। ওয়ার্নারের পর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ব্যাটিংয়ে নেমে ১০ বলেই ৩২ রানের ঝড়ো ইনিংস উপহার দেন। তবে আর বেশিদূর ম্যাক্সওয়েলকে যেতে দেয়নি বাংলাদেশ। রান আউট করে দেয়া হয়। তবে এই রান আউটে থাকে চমক। প্রথম দুটি উইকেট নেন সৌম্য। এবার সৌম্যের বলেই রান আউট হন ম্যাক্সওয়েল। এরচেয়েও আশ্চর্যের হল, রান আউট করেন রুবেল। যিনি সৌম্যের নেয়া প্রথম দুই উইকেটে ক্যাচ ধরেছিলেন। রুবেল বল হাতে কিছু করতে না পারলেও ফিল্ডিংয়ে দুটি ক্যাচ ধরেন। একটি রান আউট করেন। খাজা সেঞ্চুরির কাছে চলে যায়। ৭২ বলে ১০ চারে ৮৯ রানও করে ফেলেন। সেঞ্চুরি থেকে আর ১১ রান দূরে থাকেন। তখন সৌম্যের আঘাত আবার দেখা যায়। কী দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকেন সৌম্য। খাজাকেও আউট করে দেন। রান দ্রুত তুলতে হবে। তাই স্টিভেন স্মিথকে শুরুতে নামানো হয়নি। ছয় নম্বরে ব্যাট হাতে নেমেই মুস্তাফিজুর রহমানের শিকার হয়ে যান স্মিথ। শেষ ছয় ওভারেই চাপ তৈরি করা যায়। তা না হলে রান অনায়াসেই ৪০০ হয়ে যেতে পারত। ৩১৩ রান পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার ১ উইকেট ছিল। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যে ৩৮১ রান করল, ৬৮ রানেই ৪ উইকেট পড়ল। এখানে একটু আফসোসও জড়িয়ে থাকল। এই দুর্দান্ত বোলিং যদি আগে থেকেই হতো! সৌম্য যে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করলেন, এর আগে কখনই একাধিক উইকেট নিতে না পারা পার্টটাইম বোলার প্রথমবারের মতো ৩ উইকেট নিলেন, এই রিদম যদি অন্য বোলারদের মধ্যেও দেখা যেত। তাহলে অসিরা এত বিশাল রান করতে পারত না। ৪৯ ওভারের সময় অস্ট্রেলিয়ার ৩৬৮ রান হলে বৃষ্টি নামে। খেলা বন্ধ থাকে ২৫ মিনিট। খেলা পরিত্যক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত বৃষ্টি যেন আর না থামে, সেই প্রত্যাশাই যেন করা হচ্ছিল। কিন্তু খেলা ঠিকই শুরু হয়, মার্কাস স্টোইনিস (১৭*) ও এ্যালেক্স ক্যারি (১১*) মিলে দলকে ৩৮১ রানেও নিয়ে যান।
×