ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গারা গলার কাঁটা ॥ সঙ্কট জিইয়ে রাখছে দেশী-বিদেশী চক্র

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২১ জুন ২০১৯

  রোহিঙ্গারা গলার কাঁটা ॥ সঙ্কট জিইয়ে রাখছে দেশী-বিদেশী চক্র

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ক্রমশ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানবিক কারণে আশ্রিত প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা। নিরাপত্তার ফাঁক গলিয়ে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষের সহায়তায় এরা মিশে যাচ্ছে সমাজে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক অবৈধ কর্মকান্ডে। অনেকে পাসপোর্ট বানিয়ে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে বিদেশে। শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান না হলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাসহ নানা ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হবে। মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে সমাজ ব্যবস্থা। শুধু বাংলাদেশ নয়, আশপাশের দেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে রোহিঙ্গারা প্রথম বাংলাদেশে আশ্রয় পায়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। দেশী-বিদেশী মদদে ইয়াবা ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, অপহরণসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও সিরিজ বোমা হামলার মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে। অনেকে বাংলাদেশের নাগরিক সেজে পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। বিদেশেও তারা জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। পাকিস্তানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের একটি দল আত্মঘাতী জঙ্গী তৈরি করছে। তৈরি করা আত্মঘাতী জঙ্গীদের পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানোর অভিযোগ আছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে মারাত্মকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ছে। একের পর এক অভিযানে চলতি বছর নানা অপরাধে জড়িত প্রায় তিন শ’ রোহিঙ্গা গ্রেফতার হয়েছে। আর সাত শ’ রোহিঙ্গাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনের চেষ্টাকালে ধরে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তারপরেও তাদের অপতৎপরতা থেমে নেই। অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর রোহিঙ্গা সমস্যাকে পরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রাখতে নেপথ্যে কাজ করছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রগুলো। ইতিহাস ও গোয়েন্দা তথ্য মতে, বহু বছর ধরে রোহিঙ্গারা জাতিগত দাঙ্গাসহ নানা নির্যাতনের শিকার। নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে তার শাসনামলে বাংলাদেশে আশ্রয় দেন। অথচ মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর দাবি। জিয়াউর রহমানের আমলে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় চার লাখে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিজ দেশ মিয়ানমার ছাড়াও বিদেশে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ বহু পুরনো। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ চেকপোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই সেখানে সেনাবাহিনী দমনপীড়ন শুরু করে। সেনাবাহিনীর মারাত্মক নিপীড়নে বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে। পুলিশ সদর দফতরসহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য মোতাবেক, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত থাকার বিষয়টি জানার পরেও নিতান্তই মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। সরকার তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নির্ধারিত জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের অপরাধ প্রবণতা থেকে সরে যায়নি। তারা বাঙালীদের সঙ্গে ভাষাগত পার্থক্য ছাড়া অনেক কিছুর মিল থাকার সুযোগ নিচ্ছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে বাঙালীদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নিজেদের বাংলাদেশী পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করছে। এরপর তারা সুযোগ বুঝে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে তৈরি করা পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের বাঙালীদের সঙ্গে মিশে যাওয়া ঠেকাতে পুলিশ সদর দফতরের তরফ থেকে একটি বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে শরণার্থী শিবির ছাড়া রোহিঙ্গারা অন্য কোথাও বসবাস করতে পারবে না। রোহিঙ্গাদের কোন ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়, বাসা ভাড়া, বিয়ে করা, চাকরি, বসবাসের ব্যবস্থা, অন্যত্র চলে যেতে সহায়তা করা যাবে না। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেয়া হয়। সে মোতাবেক দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে বাড়তি তল্লাশি চৌকি বসায় পুলিশ ও র‌্যাব। অপরাধে জড়িত রোহিঙ্গাদের গ্রেফতারে এবং পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের আটক করতে চলমান অভিযানে তিন শ’ রোহিঙ্গা গ্রেফতার হয়েছে। অভিযানকালে গোলাগুলিতে পাঁচ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। সাত শ’ রোহিঙ্গাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনের চেষ্টাকালে ধরে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কোস্টগার্ডের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী পরিচালক লে. কমান্ডার এম হামিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, চলতি বছরের ৩০ মে রাতে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সাগর এলাকা থেকে ট্রলারযোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর সময় ২৮ নারীসহ ৫৮ রোহিঙ্গা নাগরিককে দুই মানবপাচারকারী চক্রের দালালসহ আটক করা হয়। পরে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে তাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে (আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে) নামীয় তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় পরিসংখ্যান ব্যুরো রোহিঙ্গাদের শুমারি করে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও পটুয়াখালী জেলায় রোহিঙ্গাদের উপর আদম শুমারি পরিচালিত হয়। কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গাদের বেশি বসবাস। এজন্য জেলাটিকে ৪৯টি জোনে ভাগ করে তালিকা তৈরি করা হয়। ৪৯টি জোনে বসবাসকারী বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের সবারই নাম রাখা হয়েছে। পরে ওই তালিকা থেকে যাছাই-বাছাই করে শুধু রোহিঙ্গাদের আলাদা তালিকা তৈরি করা হয়। রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এখনও কাজ চলছে। কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। গত বছর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াও সোয়ের নেতৃত্বে আসা একটি প্রতিনিধি দলের কাছে ৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি নামীয় তালিকা হস্তান্তর করেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের গঠিত কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উপরও গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। তবে মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মোতাবেক আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কক্সবাজারের ৯৭ রোহিঙ্গা এইডসে আক্রান্ত। এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে ইতোমধ্যেই টেকনাফ ও উখিয়ায় দুটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে এইডস আক্রান্তদের শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কলেরা রোগ না থাকলেও, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই রোগ লক্ষণীয়। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেনেটারি বাথরুম তৈরি করা শেষ না হওয়ার কারণে যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছে। এজন্য ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বন বিভাগের তথ্য মোতাবেক, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় আট শ’ একর পাহাড়ি বন কেটে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। রোহিঙ্গারা নির্বিচারে বন উজাড় করে বাড়ি তৈরি করছে। পাহাড় ও গাছপালা কেটে ফেলছে। অদূর ভবিষ্যতে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জাতিসংঘের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৭শ’ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোন উৎস না থাকায় বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কমেছে। সাত লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের অশনি সঙ্কেত। বাংলাদেশ স্বল্প মেয়াদী আর্থিক সহায়তা পেলেও দীর্ঘমেয়াদী সেই সহায়তা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। এটি একটি সার্বিক সমস্যা। এখনও বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথে হাঁটছে। শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে স্বাভাবিক কারণেই এ নিয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। হয় তো কোন কোন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে চাপে রাখতে বা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এতে করে এই সমস্যা একটি সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। তখন অন্যান্য দেশের জন্যও রোহিঙ্গারা বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ নানা সমস্যা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অতএব রোহিঙ্গা সমস্যাকে যেসব গোষ্ঠী বা দেশ বাংলাদেশের একার সমস্যা বলে ভাবছেন, তাদের সেই ভাবনা সঠিক নয়। কারণ ঝুঁকি এমন একটি বিষয়, যেটি এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এটিই স্বাভাবিক। তাই রোহিঙ্গা সমস্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সবার এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটিই রাস্তা, তা হচ্ছে তাদেরকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো। মিয়ানমারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। অন্যথায় আবারও একই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের পেছনে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজনকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বেড়েছে। এটি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তারা বিদেশে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ হবে। কারণ বিদেশে তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নামতে পারে। এটিও দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কট্টরপন্থী মনোভাবাপন্ন যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন। জঙ্গী সংগঠনগুলোও এমন সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। এতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। কারণ জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ, ইয়াবা, অস্ত্র ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধে তাদের জড়িত থাকার ভূরি ভূরি নজির আছে। দীর্ঘ সময় বসবাসের সুবাদে তারা আশপাশের এলাকায় রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। তারা রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের একটি সংগঠনও গড়ে তুলে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আশ্রয় দেয়ার কারণে রোহিঙ্গারা বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে বাড়তি সহযোগিতা পেত। কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় রোহিঙ্গাদের জঙ্গী কর্মকা- চালানো, জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া, বাংলাদেশের উগ্র ইসলামী দল, হুজি, জেএমবিসহ এ ধরনের জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকার তথ্য বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কক্সবাজারের উখিয়ায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণরত অবস্থায় হুজির ৪০ সদস্যকে বিপুল পরিমাণ ভারি অস্ত্রগোলাবারুদসহ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজারের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহ ওরফে সেলিম মোহাম্মদ ভারি অস্ত্রগোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। গোয়েন্দা সূূত্রে জানা গেছে, সেলিম উল্লাহর সঙ্গে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা ফাঁফিতে মৃত্যু হওয়া মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার আবু জান্দাল, ভারতের তিহার জেলে বন্দী সরাসরি শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলাকারী সহোদর দুই ভাই মুরসালিন ও মুত্তাকিন ছাড়াও ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গী নেতা ওবায়দুলাহ, হাবিবুলাহ, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়ামের সখ্যতা ছিল। হুজি ও জেএমবি সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করত। সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। তিনি কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বিএনপির সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, তার সহোদর ভাই কক্সবাজার জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজালাল চৌধুরীর সহোদর বোন জামাই। পরবর্তীতে বিএনপির একজন মন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলীর সহযোগিতায় হুজির ৪০ সদস্য ছাড়াও সেলিম মোহাম্মদ জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তাদের জামিনে সহযোগিতা করেছিলেন শীর্ষ ছয় জঙ্গীর অন্যতম আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই। ছাড়া পাওয়াদের অধিকাংশই এখনও আত্মগোপনে। পরবর্তীতে পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে ১২ জন গ্রেফতার হয়। সর্বশেষ সেলিম মোহাম্মদ জাপানে ছিল। সূত্রটি বলছে, সেলিমের জঙ্গী কর্মকান্ড এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রামের জিয়া সারখানা থেকে ভুয়া ভাউচারে বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত প্রায় ১২শ’ টন রক সালফার সরিয়ে ফেলে মন্ত্রীর নিয়োগ দেয়া জেএমবি সদস্য মোহাম্মদ সালাফী। সেই রক সালফারের একটি অংশ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আহলে হাদিস মসজিদে জমা করা হয়। সেখানে সেই রক সালফার কাঠের তৈরি বিশেষ বাক্সে করে জেএমবির সামরিক শাখার কাছে পাঠানোরও দায়িত্ব পালন করছিল সেলিম মোহাম্মদ। সেই রক সালফারের তৈরি বোমা দিয়ে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলা (মুন্সীগঞ্জ বাদে) অন্তত পাঁচ শ’টি জায়গায় অন্তত পাঁচ শ’টি বোমা একযোগে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছিল জেএমবি। বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী-আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে। এতে দুইজনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নানা অপতৎপরতা থেমে নেই। বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে আব্দুল করিম টুন্ডা নামের এক রোহিঙ্গা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার প্রধান কাজই হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান যাওয়া জঙ্গীদের আশ্রয় ও জঙ্গী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন দেশেও পাঠানোর ব্যবস্থা করেন আব্দুল করিম। বাংলাদেশের জেএমবির কারাবন্দী আমীর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের দুই মেয়ের জামাতাকেও পাকিস্তানে আশ্রয় ও জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে সহযোগিতা করেন আব্দুল করিম। বড় মেয়ের জামাতা শফিকুল কবির পাকিস্তান থেকে আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার পর ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। অপর মেয়ের জামাতা ইজাজ ওরফে কারগিল জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেই প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় পাকিস্তান আর্মির চালানো এক অভিযানে নিহত হন।
×