ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

দেশ এগিয়ে চলার বাজেট

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২১ জুন ২০১৯

দেশ এগিয়ে চলার বাজেট

বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ জন্য সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বগুণ প্রশংসনীয়। কিন্তু যাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেয়া হয় তারা যেন তাদের সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। এবারের বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিক হলো কৃষিখাতে ২৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটি আরোপ করাও ঠিক আছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারের গ্যাপ মার্কেট ও গ্রাভেটি মার্কেট সৃষ্টির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা করার দরকার ছিল। বিদেশ থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আনার যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে সেটি একটি ভাল দিক। কেননা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কার্যকর করতে গেলে কেবল দাম সর্বস্ব না থেকে কার্যকর শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটটি জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে প্রণীত হয়েছে। দেখা যায়, মানুষের উন্নয়ন বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুষম সম্পদ ও আর্থিক অবস্থান পূর্বের তুলনায় ভাল রাখতে পারে সে লক্ষ্যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ বাজেট মানুষের স্বপ্ন দেখাতে সহজ করে। তবে বাস্তবায়ন করতে হলে রাজস্ব আয় আহরণ ক্ষমতা অনেক দিক থেকে বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে যে সমস্ত বিত্তশালী আছে তারা যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে কর প্রদান করেন। এ ব্যাপারে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। দেখা যায়, চাকরিজীবীরা তুলনামূলক কর দিচ্ছেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণে এমন একটি ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা ধন বৈষম্যে বিশ্বাসী এবং সরকারের সদিচ্ছাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে যে কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে কর রেয়াতের জন্য সচেষ্ট থাকেন। বাজেটের ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরানোর কথা বলা হয়েছে এবং সুদের হার যথাযথ করার কথা বলা হয়েছে। এ পদক্ষেপটি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বড় ধরনের খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। না হলে ব্যাংকিং খাতে টাকা আদায় কষ্টসাধ্য হবে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যাতে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির বৃত্ত ভেঙে যায়। এছাড়া চিকিৎসা খাতের দক্ষ ও বিদেশী চিকিৎসক আনার ব্যবস্থা থাকলে ভাল হতো। এবারের বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতা থাকায় বাজেটের একাংশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপন করা। বাজেটে সরকারী কর্মকর্তাদের লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা করা হয়েছে এটি একটি ভাল দিক। বেসরকারী খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য লাইফ ইন্স্যুরেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করা দরকার। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটি গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য দরকার। শস্যবীমা প্রকল্প চালু করা এবং গবাদিপশু বীমা চালুর বিষয়টি একটি মহতী উদ্যোগ। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সুযোগ বাড়ানো একটি ভাল উদ্যোগ। ব্যাংকিং খাত সংস্কার করার জন্য ৬টি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি হতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় কিছু বড় ধরনের ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ঋণ খেলাপি আরও করতে পারে। ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলা হয়েছে। সেটি সাধুবাদযোগ্য। সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটিও একটি ভাল উদ্যোগ। তবে সার্বিক বিবেচনায় ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে সামাজিক পুঁজি গঠনের জন্য পৃথক রেগুলেটরের অধীনে কমিউনিটি ব্যাংকিং চালু করা দরকার। এবারের বাজেটটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে নিয়ে দেশের উন্নয়ন করবেন এই ধারণাপ্রসূত। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একশ’ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। দেশে যদি আত্মনির্ভরশীল কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করা যায়। তবে একটি দেশের জন্য মডেলস্বরূপ। বেসরকারী বিমান পর্যটন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আমাদের দেশের উন্নয়নকে সমৃদ্ধ করতে হলে পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদেশে চিকিৎসার জন্য মানুষ পর্যটন করতে বাধ্য হন। এতে দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যায়। সেটি বন্ধ হওয়া একান্ত দরকার। সেজন্য দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। এটি ব্যয় সাপেক্ষ হলেও দুরূহ নয়। আমাদের দেশ সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের খাত চালুর কথা বলা হয়েছে। এটিও একটি ভাল দিক। চলতি বাজেটে সম্পদের ওপর করারোপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। দেশে গত ১০ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে তা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এখন কিছু কিছু গ্রামে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে সরকারের গণমুখী পদক্ষেপ আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্পের কারণে গ্রামীণ এলাকার মাসিক আয় গড়ে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। কিন্তু তারা করের আওতায় নেই। আবার গ্রামে যে সমস্ত দোকানপাট-বাজার আছে সেগুলোর ওপর কোন কর নেই। তাই কর বৃদ্ধির যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় করের অফিস স্থাপন করা হবে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। আবার এই প্রস্তাবিত বাজেটে ২০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকায় উন্নীত করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ, রাতারাতি ৮০ লাখ করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। বন্ডেড ওয়্যার হাউস নামে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে, সেটি বন্ধ করা দরকার। এদিকে বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে কর আদায়ের যে ব্যবস্থা ছিল তা ঠিকমতো আদায় হচ্ছে না। চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা পেশাজীবীরা কর যথাযথ পরিমাণে দেয় না। দেশে প্রায় ৫০ লাখের মতো কোটিপতি থাকলেও মাত্র ১৫০ জন কোটি অঙ্কের হিসেবে কর প্রদান করে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় আমাদের দেশে অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের বদলে দেখা যাচ্ছে জর্দা অথবা বিড়ি ব্যবসায়ী করদাতা হিসেবে প্রথম হয়। কর্পোরেট গ্রুপ লবিং করে সিংহভাগ কর দেয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে আমাদের দেশে ট্যাক্স জিডিপি হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ। যেখানে ভারতে মাত্র ২৭ শতাংশ এবং নেপালে ১৭ শতাংশ। আসলে আমাদের দেশের বিত্তবানরা যদি কর না দেয় তাহলে সরকারপ্রধানের যে একটি সুন্দর রাষ্ট্র গড়ার বাসনা সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। মাউশির রিপোর্টে দেখানো হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ সৃজনশীল সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছে। সরকারের এই অর্থের অপচয় রোধ করে বাস্তবসম্মতভাবে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। সব সময় দেখা যায় ভাল উদ্যোগকে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী নিজেদের আখের গোছানোর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। এই প্রথাটি বন্ধ করা দরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী যাতে ১ জুলাই হতে কার্যকর করা যায়Ñ সে জন্য প্রথম দিনেই অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। শেষ প্রান্তে এসে তাড়াহুড়া করে প্রকল্প গ্রহণ করলে সেটা ভাল হবে না। স্বর্ণের ওপর কর হ্রাসের কোন যৌক্তিকতা নেই তবে বাংলাদেশের যে সমস্ত বড় বড় মোবাইল অপারেটর আছে তারা যেন কর ফাঁকি দিতে না পারে এবং বছরের পর বছর কর নিয়ে গড়িমসি না করে সে জন্য দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজস্ব বাজেট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী দুটিকেই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সুন্দরভাবে পরিকল্পিত করা হলেও এখন এটি যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলেই দেশের মঙ্গল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলুক এবং মানুষের আর্থিক মুক্তি ঘটুক ও দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতিমুক্ত থাকুক- এই প্রত্যাশা রইল। উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে যে, ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা কীভাবে শিক্ষিত তরুণ যুবসমাজ চাকরি না পেয়ে কাজে লাগাবেন সে ব্যাপারে একটি সুন্দর পরিকল্পনা থাকা দরকার। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে যেন সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিকাশে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে জীবনমান অগ্রসর করতে এবং আয় বৈষম্য হ্রাস করতে বদ্ধপরিকর। সেহেতু আমরা আশা করব কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা করতে বসবেন না। কেননা সরকার ইতোমধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রমের আওতায় ৯টি প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেছেন এটির সুফল মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। এর পাশাপাশি বলতে চাই সরকার ৮ বিলিয়ন ডলার সৃজনশীল শিক্ষার জন্য খরচ করলেও সাম্প্রতিক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অধীনস্থ মূল্যায়ন অধিদফতরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ৮ মিলিয়ন ডলার সৃজনশীল প্রশ্নের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। অথচ ইতোমধ্যে সাড়ে তিন লাখের ওপর প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ [email protected]
×