ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডিআইজি মিজানের ১৩ বছরের ভাগ্নের নামেই জমা এক কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২০ জুন ২০১৯

 ডিআইজি মিজানের ১৩ বছরের ভাগ্নের নামেই জমা এক কোটি টাকা

শংকর কুমার দে ॥ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ডিআইজি মিজানের ১৩ বছরের এক ভাগ্নের নামে জমা পাওয়া গেছে এক কোটি টাকা। তাও আবার এই ভাগ্নের বাবা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। ডিআইজি মিজানের ঘুষ কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে গিয়ে এমনই তথ্য পেয়েছে পুলিশ ও দুদকের তদন্ত কমিটি। ‘কেচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে’ প্রবাদের মতোই ঘটনা বলে মন্তব্য করছেন তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে এখন পুলিশ ও দুদকের দুই তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ডিআইজি মিজান সুচতুর। তিনি নিজ নামে খুব বেশি ধন সম্পদ না করলেও তার আত্মীয় স্বজনের নামে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। তার স্ত্রী, ভাই, ভাগ্নের নামে কোটি কোটি টাকার ধন সম্পদের সন্ধান পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রাথমিক তদন্তে ডিআইজি মিজান এবং তার স্ত্রী, ভাই ও ভাগ্নের নামে কম করে হলেও ৪ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে তদন্তের গভীরে গেলে আরও ধন সম্পদের তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ডিআইজি মিজান সম্পদ বিবরণীতে ধন সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন এমন তথ্যও পাওয়া গেছে তদন্তে। তার ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা গোপন রেখেছেন তিনি। এ জন্য মানিলন্ডারিং এর মামলাও হতে পারে তার বিরুদ্ধে। ডিআইজি মিজান যে ফ্ল্যাটে থাকেন তা তার ভাইয়ের নামে। যদি ভাইয়ের নামেই ফ্ল্যাট হয় তাহলে তিনি বসবাস করেন কেন? এমন প্রশ্নও তুলেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে তার স্ত্রীর ধন সম্পদের বিষয়ে এখন আরেকটি তদন্ত চলমান আছে বলে জানা গেছে। ডিআইজি মিজানের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মইনুর রহমান চৌধুরী (এ্যাডমিন এ্যান্ড অপারেশন)। পুলিশের এ তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মিয়া মাসুদ হোসেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে কমিটিকে কোন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। তবে দ্রুত তাদের কার্যক্রম শেষ করতে বলা হয়েছে। এর আগে ডিআইজি মিজানের নারী কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিতেও নেতৃত্ব দেন মইনুর রহমান চৌধুরী। এ ছাড়াও তার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে, তিনি ঘুষের টাকা কোথায় পেয়েছেন, উৎস কি, কিভাবে ঘুষ দিয়েছেন ? যেহেতু ডিআইজি মিজান নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ লেনদেন ফৌজদারি অপরাধ। এজন্য তাকে বরখাস্ত করার জন্য ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল পাঠানো হয়েছে। তিনি ওএসডি ও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ও দুদুকের পৃথক তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করে দেখতে পেয়েছেন, ডিআইজি মিজান স্বনামে তেমন কোন ধন সম্পদ করেননি। তবে তার নিকটাত্মীয়ের নামে অনেক ধন সম্পদ পাওয়া গেছে, যা সন্দেহজনক। ডিআইজি মিজানের আরেক ভাগ্নে যিনি ডিএমপির এক থানায় শিক্ষানবিস এসআই (পিএসআই) হিসেবে কর্মরত তার নামেও বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক ফ্ল্যাট রয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচা ট্রেড সেন্টারে ১৯১৯ বর্গফুটের বাণিজ্যিক ফ্ল্যাটটির বিষয়েও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এই ফ্ল্যাটটির দাম দেখানো হয়েছে ৫৯ লাখ ৯ হাজার টাকা। অথচ ওই ফ্ল্যাটের দাম ছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা। ওই ফ্ল্যাটটি মাসে লাখ টাকা ভাড়ায় একজন ব্যবসায়ী রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টার পরিচালনা করছেন। রাজধানীর বেইলি রোডের বেইলি রিজ আবাসিক ভবনের ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রেশন করা হয় মিজানের একমাত্র ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান স্বপনের নামে। ২৪০০ বর্গফুটের আলিশান ওই ফ্ল্যাটের দাম হয় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ জমির মূল্যসহ ফ্ল্যাটের সাবকবলা দলিলে দাম দেখানো হয়েছে ৪৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। উত্তরায় ১৩নং সেক্টরে ৮নং রোডে ২৯ নং বাড়ির ফ্ল্যাটে এক ছেলে নিয়ে থাকেন মিজানের স্ত্রী সোহেলীয়া আনা রত্না। তিনি গুলশান পুলিশ প্লাজা মার্কেটে লেভেল ৩-এ ৩১৪নং ‘লেডিস মার্ট’ শোরুমের মালিক। ডিআইজি মিজানুর রহমানের দুই ছেলে কানাডার ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। এছাড়া তিনি পূর্বাচলে সরকারীভাবে পাঁচ কাঠার জমিও পেয়েছেন। সাভারের পুলিশ কলোনিতেও পেয়েছেন ফ্ল্যাট। একটি দামী গাড়িসহ একাধিক গাড়িতে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা চলাফেরা করেন। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিআইজি মিজানের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ‘থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে’। শুধু ডিআইজি মিজানই নয়, তিনি যেসব আত্মীয় স্বজনের নামে অবৈধভাবে ধন সম্পদ গড়ে তুলেছেন তারাও ফেঁসে যেতে পারেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার দাবি।
×