ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কংগ্রেসের ভরাডুবির নেপথ্যে

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ১৯ জুন ২০১৯

কংগ্রেসের ভরাডুবির নেপথ্যে

ভারতে লোকসভা নির্বাচনে পর পর দ্বিতীয়বার কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলোর শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। বলা যেতে পারে যে বিজেপি এই দলগুলোকে বিশ্বস্ত করে দিয়েছে। অথচ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগেও কংগ্রেস নিশ্চিত ছিল যে বিজেপি জোট ২৩০টির বেশি আসন পাবে না। কংগ্রেসের এই ধারণার সঙ্গে মাঠের পরিস্থিতির কোন মিল ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ কিছু ভুল কৌশল, তহবিলের অভাব, দলের মধ্যে সংহতি না থাকা এবং সর্বোপরি নেতৃত্বের ভিশন বা দৃষ্টিকল্পের অভাব দলটির বিপর্যয় ডেকে এনেছে। পর্যবেক্ষকরা কংগ্রেসের এই মহা বিপর্যয়ের প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত রাহুল গান্ধী তার নাবালকের ইমেজ বহু আগেই কাটিয়ে এলেও জনগণের চোখে ক্যারিশমা, বিশ্বাস যোগ্যতা ও যোগাযোগগত দক্ষতার দিক দিয়ে তিনি নরেন্দ্র মোদির ধারে কাছেও ভিড়তে পারেননি। দ্বিতীয়ত নির্বাচনে লড়ার জন্য যে ধরনের সুসংহত, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক দল থাকা দরকার রাহুলের তা কখনই ছিল না। তিনি অনবরত তার পরামর্শকদের বদল করেছেন। একদিন যদি তিনি রণদীপ সূর্যেওয়ালা ও আহমেদ প্যাটেলের পরামর্শ শুনেছেন তো আরেকদিন তিনি কেসি ভেনুগোপাল ও রাজীব সাতারের কথামতো চলেছেন, একদিন যদি তার দল বালাকোটে বিমান হামলার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকে সমর্থন করেছে তো পরদিনই আবার এই হামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রাহুল রাফায়েল চুক্তির দুর্নীতি নিয়ে মোদিকে টার্গেট করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এতই জটিল ছিল যে তা গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। মোদির সবচেয়ে বড় শক্তি তার দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তি। সেই ভাবমূর্তিকে আঘাত হানার চেষ্টা বুমেরাং হয়েছে। গত পাঁচ বছরে উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার মতো বড় রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের সংগঠন গড়ে তোলার কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ ছিল না। এসব জায়গায় কংগ্রেসের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এই রাজ্যগুলোর ২৪৩ আসনে কংগ্রেস ছিল এক দর্বল কুশীলব। এমনকি মধ্য প্রদেশ, গুজরাট, অসম ও উত্তরা খ-ের মতো রাজ্যগুলোতে যেখানে কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী সেখানেও বলিষ্ঠ স্থানীয় নেতৃত্ব লালন করার কোন উদ্যোগ ছিল না। শুধু রাজস্থানে শচীন পাইলট, মহারাষ্ট্রে অশোক চ্যাবন ও কর্নাটকে সিদ্ধারামালাকে সংগঠন পরিচালনায় অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তারাও তেমন কিছুই করতে পারেনি। রাহুল কংগ্রেসের রাজ্য শাখার নেতৃত্ব পদে এমন কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন যাদের ওই নিযুক্তি হিতে বিপরীত হয়েছে। হরিশ রাওয়াতের মনোসংযোগ থেকে গিয়েছিল উত্তর খ-। ঝানু রাজনীতিক শক্তি সিং গোহিলকে বিহারের দায়িত্ব দেয়া হয় হয় সেখানে কংগ্রেস ছিল জোটের এক অপ্রধান মিত্র। কর্নাটকে যিনি কঠিন লড়াই চালিয়েছিলেন সেই মল্লিকার্জুন খার্গকে মহারাষ্ট্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আর অনভিজ্ঞ গৌরব গোগোইকে দেয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা বড় রাজ্যের দায়িত্ব। কংগ্রেস সামাজিক মাধ্যমে বিজেপির বিরুদ্ধে উদ্যমী লড়াই লড়েছিল। অথচ দলটির বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। বিভিন্ন টিমের প্রধানদের মধ্যকার ইগোর লড়াই বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তোলে। শিবভক্ত হিন্দু হিসেবে রাহুলের আবির্ভাব কংগ্রেসকে বিজেপির অনুরূপ দলে পরিণত করে। এতে উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের মতো রাজ্যগুলোতে দলটির মুসলিম ভোট ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে এবং দিল্লীতে আম আদমী পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাও দলটির ভরাডুবির কারণ। দলটির তহবিল সঙ্কট প্রকট ছিল। যে সীমিত অর্থ দলের তহবিলে ছিল তাও অনেক প্রার্থীর কাছে পৌঁছেনি। কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণা এমন ছিল যে কংগ্রেস মোদির বিরোধিতা করা ছাড়া আর কি জন্য দাঁড়িয়েছে তার কোন হদিস ভোটারদের অনেকেই পায়নি। দলটি কৃষকদের দুর্গতির কথা বলেছে, বেকারত্বের কথা বলেছে। এর বহুল প্রকাশিত ইশতেহারে সে সবের উল্লেখও ছিল। কিন্তু ইশতেহারটি এত বিলম্বে বেরিয়েছে যে তাতে কাজ হয়নি। ভোটারদের কাছে ইশতেহারের বার্তাগুলো পৌঁছেনি। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় কংগ্রেসের ন্যূনতম আয় নিশ্চয়তা স্কিম ২ এপ্রিল অর্থাৎ নির্বাচন শুরু হওয়ার মাত্র ৯ দিন আগে প্রকাশ করা হয়। ওই স্কিমের মাধ্যমে দলটি দারিদ্রতম ২০ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে বছরে ৭৯ হাজার রুপী জমা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দিল্লীর খান মার্কেটে এই স্কিমের বিবরণ সংবলিত এক বিশাল বিলবোর্ড টাঙানো হয়েছিল। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছিল। এক. এমন এক বিলবোর্ডের পেছনে অর্থ ব্যয়টাই সম্পূর্ণ পানিতে গিয়েছিল। কারণ এই বার্তাটি যাদের কাছে পৌঁছানোর কথা সেই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে যায়নি। দ্বিতীয়ত খান মার্কেট এমন এক জায়গা সেখানে বড় লোকেরা ও মধ্যবিত্ত লোকজন প্রায়শই যাওয়া-আসা করে। ওই বিলবোর্ড দেখে তাদের শঙ্কিত বোধ করার কথা যে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ওই অর্থ যোগাতে সরকার তাদের ওপর বাড়তি কর বসাতে পারে। এমনই ছিল দলটির এক একটা ভ্রান্ত পদক্ষেপ। ২০১৪ সালে নির্বাচনী ভরাডুবির পর কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন কিভাবে ঘটতে পারে তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর পর দলটির এতটুকু কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে দলটির অবস্থা তলানিতে নেমে এসেছে। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×