ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় প্রাসাদ, ধ্বংস হতে চলেছে অযত্নে

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১৮ জুন ২০১৯

ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় প্রাসাদ, ধ্বংস হতে চলেছে অযত্নে

সাজেদুর রহমান শিলু ॥ দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান ও দিনাজপুর রাজবংশের আবাসস্থল রাজপ্রাসাদ অযত্ন আর অবহেলার কারণে আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। চরম অবহেলায় দিনের পর দিন রাজ প্রাসাদে থাকা অতি মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী এই দর্শনীয় স্থান এবং দিনাজপুরের রাজবংশের প্রতীক রাজপ্রাসাদের স্মৃতি রক্ষায় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে দাবি জানিয়েছেন সচেতন সমাজ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিনাজপুরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৪শ’ বছর ধরে প্রায় ১শ’ ৬৬ একর জায়গাজুড়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বিশাল প্রাসাদ। দিনাজপুর রাজবাড়িতে রয়েছে আয়না মহল, রানী মহল ও ঠাকুরবাড়ী মহল। এছাড়াও ফুলবাগ, হীরাবাগ, সবজিবাগ, পিলবাগ, দাতব্য চিকিৎসা, অতিথি ভবন, কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা, প্রশাসনিক ভবন ও প্রসাদের মধ্যে কয়েকটি বিরাট দীঘি রয়েছে। দ্বিতল আয়না মহলে নিচে ওপরে মিলে ২২ করে মোট ৪৪ কক্ষ রয়েছে। এই ভবনের ছাদ, পিলার ও দেয়াল মূল্যবান স্ফটিক মতি ও মার্বেল পাথর খচিত ছিল। এছাড়াও রাজপ্রাসাদ এলাকায় জলসাগর, তোষাখানা, পাঠাগারসহ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভবন এই মহলে অবস্থিত। আয়না মহলের উত্তরে রানীর দেউড়ি পেরিয়ে রানী মহল অবস্থিত। জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই রাজপ্রাসাদের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণ ও অবহেলার চোখে দেখে আসছিল। তখন থেকেই এই রাজপ্রাসাদের মধ্যে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হতে থাকে। তৎকালীন সরকার রাজপ্রাসাদের আয়না মহলকে ব্যবহার শুরু করে এতিমখানা হিসেবে। এরপর রাজপ্রাসাদের বিশাল সবুজ চত্বরে তৈরি করা হয় এতিমদের জন্য পাকা ভবন। রাজবংশের শেষ রাজা জগদীশ চন্দ্র রায় বাহাদুরের একমাত্র পুত্র রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী রাজকুমার জলধিনাথ রায়-এর জন্য নির্মিত রাজকুমার ভবনটি এখন বেদখল হয়ে আছে। দিনাজপুরের রাজবাড়ি একদিকে যেমন জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান, অন্যদিকে এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুণ্যস্থান। রাজবাড়ির মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। প্রায় দিনই সেখানে পূজা, কীর্তন হয়ে থাকে। দিনাজপুরের রাজবাড়িতে কান্তজিউ আসার পর থেকে প্রতিদিনই সেখানে ভোগ দেয়া হয়। রাজবাড়ির কান্তজিউ মন্দিরের বাইরে পুরনো দিনের সুন্দর সুন্দর নক্সা রয়েছে। এর ভেতর থেকে আসা পানি যে মুখগুলো দিয়ে পড়ে, সেই মুখগুলো লোহার তৈরি বাঘের মাথা। এছাড়াও এই প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে দুর্গাদেবীর মন্দির। এই মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। এর বাইরে বসে বিশাল মেলা। এই মেলায় শুধু হিন্দুরা নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনেরও সমাগম ঘটে। রাজ প্রসাদের ভেতরের ঘরগুলো বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় কেউ ভেতরে প্রবেশ করে না। তবে এর ভেতরের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। প্রাসাদের রুমগুলোতে কেউ বসবাস না করায় সেখানে বিভিন্ন গাছ, লতা-পাতার জন্ম হয়েছে। এই গাছে রয়েছে এক প্রজাতির শামুক। এই শামুকগুলো দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। রুমগুলো তৈরি করতে যে লোহার প্রয়োজন হয়েছিল, সেগুলোও বর্তমানে চুরি হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে এই প্রাসাদের ভেতরে একটি সুরঙ্গের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পরে তা প্রশাসন বন্ধ করে দেয়। রাজ প্রাসাদের আয়না মহল, রানী মহলসহ রাজবংশের পুরো আবাসিক এলাকাটি এতিমখানা বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে। আয়না মহল, রানী মহলের মূল্যবান মার্বেল পাথর, স্ফটিক মতি, অসংখ্য স্টিলের বিশাল বিশাল বীমগুলো দিনের পর দিন ধরে অপরাধী চক্র পাচার করে বিক্রি করে ফেলেছে। কোটি কোটি টাকার মালামাল সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে।
×