ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাগেরহাটের কান্দাপাড়া গণহত্যা ॥ ১৮ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ১৮ জুন ২০১৯

 বাগেরহাটের কান্দাপাড়া গণহত্যা ॥ ১৮ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৮ জুন দিনটি ছিল শুক্রবার। একাত্তরের এই দিনে লে. হুমায়ূনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে পাকসেনাদের সাইদাবাদ ঘাঁটির পেছনদিক থেকে প্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা তিনটি জঙ্গী বিমানের সহায়তায় পাল্টা আক্রমণ জোরদার করে। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদল গ্রামের গোপন পথে মেঘনার দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে ৫০-৬০ জন পাকসেনা হতাহত হয় ও তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কুমিল্লার মুক্তিবাহিনীর কৈখোলা অবস্থানের ওপর পাকসেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচ- আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে কৈখোলা পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। রাতে মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানি কৈখোলায় অবস্থানরত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। এছাড়া হাবিলদার সালামের প্লাটুন শিবপুরের দিক থেকে এবং সুবেদার আবদুল হক ভুঁইয়ার প্লাটুন দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুসেনাদের অবস্থানের ভেতর অনুপ্রবেশ করে। দুই ঘণ্টাব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর পাকসেনারা কৈখোলা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে এবং মুক্তিবাহিনী কৈখোলায় তাঁদের দখল পুনঃস্থাপন করে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন জেসিওসহ ৩১ জন সৈন্য হতাহত হয় । মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জাম দখল করে। মিয়াবাজারের দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকসেনাদের দুটি বাঙ্কারের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। কুমিল্লায় একদল মুক্তিযোদ্ধা খিলা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পাকসেনাদের একটি জিপকে এ্যামবুশ করে। এ অভিযানে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। দিনাজপুর জেলার ঠনঠনিয়াপাড়ায় পাক অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী বড় রকমের হামলা চালায়। আধঘণ্টা ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ঠনঠনিয়া মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৫ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর লে. ইমামুজ্জামানের কোম্পানি বিলোনিয়ার চিতলিয়া অবস্থানের ওপর পাকিস্তান বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে ব্যাপক হামলা চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র সরে পড়ে। বাগেরহাট সদরের কান্দাপাড়া বাজারে পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। এখানে পাকবাহিনীর দোসর রাজাকাররা ১৮ জন যুবক, ৩ জন বৃদ্ধ ও ২ জন শিশুকে জবাই করে মাথাগুলো বিচ্ছিন্ন করে লাশের বুকের ওপর রেখে রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে। মৌলভীবাজারে পাকবাহিনীর জুড়ি অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ২৫ জন সিপাই নিহত হয় এবং ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দেশত্যাগী পাকিস্তানীর প্রতি স্বদেশ ফিরে আসার আবেদন জানান। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, বিচারপতি নূরুল ইসলাম, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কাজী দীন মোহাম্মদ ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি’ হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে সাক্ষাত করেন। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম লাহোরে বলেন, ‘কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে? ক্ষমতা গ্রহণের জন্য দরকার একটি জাতীয় পরিষদ। আমাকে বলুনতো দেশে জাতীয় পরিষদ আছে কি? কোনমতেই বেআইনী ঘোষিত ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ক্ষমতা দেয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিযোদ্ধা) এখনও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। নকশালী ও কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত এসব দুষ্কৃতকারীরা জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খল অবস্থা দীর্ঘায়িত করতে চায়। দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায়’ আমি তাদের ফেরত পাঠাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে ভারতের সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অর্থনৈতিক সম্পাদকদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে মিসেস গান্ধী প্রধানত পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ ভারতের উপর ‘বোঝা’ হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেন। এত অল্প সময়ে এই ধরনের বিশাল বোঝা বহন করা যে কোন দেশের জন্যই কঠিন। মিসেস গান্ধী স্বীকার করেন ভারতের এই শরণার্থীদের জন্য একটি বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে। এগুলো পরিকল্পনা কমিশন ও অন্যান্য বিভাগের দ্বারা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার উপরও এটা নির্ভর করে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাবে কোন পার্থক্য আসবে না। শুরু থেকে ভারত একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে আসছে। ‘আমি নিশ্চিত যদি সব বিশ্বশক্তিগুলো চাপ দেয় তবে এটা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু মনে হয় সে আশা সুদূর পরাহত। ভারতের শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে, বাংলাদেশের ব্যাপারে দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু ইউরোপীয় দেশ সফর করে গত রাতে ফিরে আসেন। তার অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন, হল্যান্ড এবং ইতালি সফরের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীকে জানান। ছয় মিলিয়ন শরণার্থীর জন্য সৃষ্ট গুরুতর সমস্যার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি আশ্বাস পেয়েছিলেন যে তাদের মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধান আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন- বর্তমান সরকার পাকিস্তানকে বাংলাদেশে তাদের সামরিক কর্ম বন্ধ এবং রাজনৈতিক সমাধান চাওয়ার কথা বলেছে। দেশগুলোকে বোঝানো হয়, যে গণহত্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা; অতএব এটা সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়। তিনি এ সকল দেশকে অনুরোধ করেন যাতে তারা পূর্ববাংলায় একটি রাজনৈতিক সমাধান চাইতে এবং ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে ‘সম্মান ও শান্তিতে বাড়ীতে ফিরে যাবার পরিবেশ তৈরি করতে পাকিস্তানকে বাধ্য করতে। সেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অবিলম্বে বন্ধ করতে। প্রতিরক্ষার জন্য পাওয়া অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান নির্দোষ এবং নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা করছে। আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা ও দাতাদেশগুলোর পাকিস্তানকে দেয়া সমস্ত মানবিক সাহায্য তত্ত্বাবধান করা উচিত ও সেসব ত্রাণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর বিষয় তাদের তত্ত্বাবধান করা উচিত। উল্লেখ্য, পূর্ববঙ্গে মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড়ের পরে এইড হিসাবে দেয়া স্পিডবোট এখন সেখানে মানুষ হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। পিটিআইয়ের বরাতে সিপিআইএমের সভার রেজ্যুলেশনের উদ্ধৃতি দিয়ে অপর এক সংবাদে বলা হয়েছে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি বিলম্বের প্রশ্নে ভারত সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন সরকার স্পষ্টতই আমেরিকা এবং অন্যকিছু মহলের চাপে আছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশকে সবরকম উপকরণ সহায়তা প্রদান না করায় বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ৫ মিলিয়নের ও বেশি বাঙালী ভারতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। এই বিশাল উদ্বাস্তুর অন্তঃপ্রবাহ ভারতে এবং বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ে বড় ধরনের সমসা তৈরি করেছে। এর জন্য ভারত সরকার দায়ী কারণ তারা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এবং পূর্ববাংলায় পর্যাপ্ত সকল সরবরাহ সহায়তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×