ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে জাতিগত বিদ্বেষ নীতি গ্রহণ করেছে মিয়ানমার ॥ জাতিসংঘ

রাখাইনে সহায়তা বন্ধের হুমকি

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ১৮ জুন ২০১৯

রাখাইনে সহায়তা বন্ধের হুমকি

রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার জাতিগত বিদ্বেষ নীতি গ্রহণ করায় এই রাজ্যকে দেয়া সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়ার হুমকি দিয়ে মিয়ানমার সরকারকে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘ। চলতি মাসের ৬ তারিখে মিয়ানমারের সামাজিক নিরাপত্তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী ডক্টর উইন মিন্ত আয়েকে লেখা এক চিঠিতে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক কোনাট অস্টবি এই হুঁশিয়ারি দেন।খবর দ্যা গার্ডিয়ান অনলাইনের। চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাতে মিয়ানমার সরকার যদি জাতিগত বিদ্বেষ নীতি থেকে সরে না আসে তা হলে ওই রাজ্যের জন্য দেয়া সহায়তা তুলে নেয়া হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পাঠানো বন্ধ করবে না। সাত বছর ধরে জাতিসংঘ রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কারণে বাস্তচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য নিয়মিত সহায়তা পাঠিয়ে আসছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, রাখাইনের ঠিক যেসব জায়গায় রোহিঙ্গাদের সাংবিধানিক অধিকার ও চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে আমরা ঠিক সেসব ক্যাম্প বা এলাকায় সহায়তা পাঠানো অব্যাহত রাখব। কোনাট অস্টবি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে এই জনগোষ্ঠী ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার রাখাইনের আইডিপি ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। আইডিপির এসব ক্যাম্পে অন্তত একলাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। ২০১২ সালে এক সহিংসতায় এসব লোক ঘরবাড়ি হারিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ক্যাম্পে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতসেতে পরিবেশে এসব লোক বাস করে। এদের স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ মেনে নিতে সম্মত হয়। আনান কমিশনের ওই সুপারিশে বলা হয়, সহিংসতায় ঘরবাড়ি হারানো লোকদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে হবে, তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতে হবে । এছাড়া রোহিঙ্গা পরিস্থিতি উন্নয়নে আরও একাধিক সুপারিশ করা হয়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো রাখাইনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর জেনেছে, দীর্ঘদিন পরও রাখাইন পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। এখানে বসবাসরত নাগরিকদের প্রকৃত মৌলিক অধিকার নেই। সাধারণ রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিকদের চলাচলের স্বাধীনতা ও জীবন ধারণের নিজস্ব অধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সামাজিক নিরাপত্তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী ডক্টর উইন মিন্ত আয়েকে লেখা ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি বন্ধ করে দেয়া ক্যাম্পসমূহ ও নতুন করে তৈরি ক্যাম্পে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এসব ক্যাম্পে বসবাসরতদের কোন মর্যাদা নেই। তাদের জীবন ধারণ ও বেঁচে থাকার মতো মৌলিক অধিকারসমূহ নেই। আগের ক্যাম্পগুলোর মতো নতুন করে তৈরি করা ক্যাম্পের পরিস্থিতিও নোংরা ও স্যাঁতসেতে। এ বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র জাতিসংঘ কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য কিছু স্থায়ী ক্যাম্প তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত সহিংসতা চিরদিনের জন্য অব্যাহত রাখবে। আর এসব নাগরিকের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও নিয়মিত সহায়তা করে যেতে হবে। মিয়ানমারে বসবাসরত জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রোহিঙ্গারা বেশি নির্যাতনের শিকার। ২০১২ সালে স্থানীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে সহিংসতায় হাজার হাজার রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭’র আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এখনও অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে রয়েছে। জাতিসংঘ দীর্ঘদিন মিয়ানমার সরকারকে পরিস্থিতি উন্নয়নে সতর্ক করলেও এই প্রথম উল্লেখযোগ্য ও কঠোর নীতি গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক লঁরা হেই বলেন, রাখাইনে মিয়ানমার সরকার দীর্ঘদিন থেকে কঠোর জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে আসছে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আমরা রাখাইন পরিস্থিতির ত্বরিত উন্নয়ন দেখতে চাই। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবাধিকার ও জীবন ধারণের পরিস্থিতি উন্নয়নে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, নানা সংগঠন ও দেশসমূহের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
×