ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে প্রফিট বোনাস আটকে রেখে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ১৭ জুন ২০১৯

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে প্রফিট বোনাস আটকে রেখে চাঁদাবাজি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রফিট বোনাস আটকে রেখে প্রায় ৬০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির প্রমাণ পেয়েছে পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটি। এ কারণে দেশের একমাত্র এই কয়লা খনির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কয়লা খনির উৎপাদন পরিকল্পনা ও সুষ্ঠুভাবে কোম্পানি পরিচালনা কাজে মনোনিবেশ না করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, শো’কজ, পরামর্শপত্র, সতর্কতাপত্র ও এসিআর খারাপ দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এসব কারণে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ যেকোন সময় বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। ধর্মঘটের মতো কর্মসূচীতেও যেতে পারে তারা। ইতোমধ্যে এলাকাবাসীও এসব ঘটনায় একাধিকবার বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। অথচ দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পেলেও কর্তৃপক্ষ বড়পুকুরিয়ার বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর পরিবর্তে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য প্রমাণের বিষয়ে শুধুমাত্র কোম্পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে পেট্রোবাংলা। এছাড়া ইচ্ছেকৃতভাবে কয়লা খনিতে উৎপাদন বন্ধ রাখা এবং প্রকল্প এলাকার উন্নয়ন কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না করলেও চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ (এলডি) আদায় না করে চুক্তি লঙ্ঘনের মাধ্যমে উল্টো অতিরিক্ত বিলসহ প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়েও কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রফিট বোনাস আটকে রেখে কয়লা খনি কোম্পানির স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সকলের কাছ থেকে মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়। লক্ষ্য ছিল ১৪৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে মোট এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা আদায় করা। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপত্তির মুখে টাকার অঙ্ক কমিয়ে মাথাপিছু ৬০ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। এতেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপত্তি তুললে তাদের বদলি-শোকজসহ হয়রানি হুমকি দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে প্রত্যেকে ৪০ হাজার টাকা করে চাঁদা দেন। এভাবে প্রায় ৫৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা ছাড়াও গণহারে শোকজ করা হয়। গণমাধ্যমকে ভবিষ্যতে আর কোন তথ্য না দিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিঠিও দেয়া হয়। এ সময় তাদের মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে দেখার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। চাঁদাবাজির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে পেট্রোবাংলার জিএম (মাইন অপরেশন) ডি এম জোবায়েদ হোসেনকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরও এক সদস্যকে কমিটিতে কো-অপ্ট করা হয়। কিন্তু পদে রেখে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করায় তদন্ত কমিটির কাছে ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এরপরও তদন্ত কমিটি দীর্ঘ তদন্তে চাঁদাবাজি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। জানা যায়, প্রফিট বোনাস আটকে রেখে প্রায় ৬০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে গত ২৯ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি গঠন করে পেট্রোবাংলা। এই অভিযোগের মধ্যেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা স্ত্রীসহ তিনদিনের জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ঘুরে আসেন। এরপর তদন্ত কমিটির প্রধানকে চীনও ঘুরিয়ে আনা হয়। এরপরও তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তাও কম নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত কমিটি মোট ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য গ্রহণ করে। এ সময় তদন্তে যথেষ্ট বাধারও সৃষ্টি করা হয় বলে সূত্র জানায়। আবার অভিযুক্ত কর্মকর্তা স্বপদে বহাল থাকায় অনেকে তথ্য দিতে ভয়ও পান। মূলত : চার খুঁটির জোরে রক্ষা পাচ্ছেন ওই কর্মকর্তা। এদের একজন মন্ত্রণালয়ের এবং আরেকজন পেট্রোবাংলার শীর্ষ কর্মকর্তা। এর বাইরে বাকি দুই কর্মকর্তা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতেই কর্মরত। এতে কোম্পানিতে একটি বিরূপ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলেও কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কয়লা খনির ভবিষ্যত নিয়ে কারিগরি কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি। জানা যায়, ইচ্ছেকৃতভাবে কয়লা খনিতে উৎপাদন বন্ধ রাখা এবং প্রকল্প এলাকার উন্নয়ন কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না করায় এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ (এলডি) আদায় না করে উল্টো অতিরিক্ত বিলসহ প্রায় ১৮০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। অথচ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে পর পর চারটি আপত্তি উত্থাপন করা হয়। ফলে বিল পাস করার কৌশল হিসেবে চীনা কোম্পানি প্রায় সপ্তাহখানেক কয়লা উৎপাদন বন্ধ রাখে। এক পর্যায়ে চীনা কোম্পানির অবৈধ বিল পাস করিয়ে দেয়া হয়। অথচ রহস্যজনক কারণে জ্বালানি বিভাগও এসব বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
×