ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়ঙ্কর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ॥ ১৬ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৬ জুন ২০১৯

 ভয়ঙ্কর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ॥ ১৬ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৬ জুন দিনটি ছিল বুধবার। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালীদের নিরঙ্কুুশ বিজয়ের পরও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেবার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিমা শক্তি গণহত্যা শুরু করেছে। ধ্বংসযজ্ঞ আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বাস্তব সত্য হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অস্বীকার করার কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছে না। বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করার স্বপ্ন যারা দেখেছিল, বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যারা বাংলাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, তারা বাংলার অকুতোভয় মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি। পাকসদর দফতরে যুদ্ধের আছড় না লাগলেও বাংলার মাটিতে মৃত্যুভয়ে ভীত পাকসেনাদের আর্তচিৎকারে ইয়াহিয়ার মসনদ কেঁপে উঠেছে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা ও পাকবাহিনীর বর্বরতা ঐক্যের ওপর প্রচন্ড আঘাত হেনেছে। বাংলার মুক্তি সেনাদের বিজয় উল্লাস সময়ের ব্যাপার মাত্র! এই দিন চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর চাঁদগাজী ঘাঁটির ওপর পাকসেনারা তীব্র আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের ৫০ জন সৈন্য নিহত হয়। কুমিল্লার রাজাপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি থেকে টহল দিতে আসা পাকসেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা এ্যামবুশ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। সংঘর্ষ শেষে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট ও অন্যান্য জিনিস মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কসবা অবস্থান থেকে একটি দল বগাবাড়ি নামক স্থানে পাকবাহিনীর একটি টহল দলকে এ্যামবুশ করে। এ অভিযানে পাকবাহিনীর ১০ জন সেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। গোপালগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের কোদালধোয়া ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী চারটি স্পিডবোটে করে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করলে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা পয়সারহাট থেকে আট মাইল দূরে পালায়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ৯ জন সৈন্য নিহত হয়। ঝালকাঠির বৈশাইল থানা এলাকায় হানাদার পাকসেনারা স্থানীয় দারারদের সহায়তায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। যশোরের বেনাপোল পাকবাহিনীর ঘাঁটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনী প্রচুর ক্ষতির শিকার হয়। এই দিন পিরোজপুরের পাক বাহিনীর হাতে পৈশাচিক নৃশংসতায় শহীদ হয়েছেন বিধান চন্দ্র হালদার মন্টু। তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্রনেতা সেলিম, পূর্ণেন্দু, বাচ্চু, প্রবীর দেব, পংকজ, আসাদ, দুলাল, অনিল, প্রতুল, অনীন্দ্র কর্মকার, মতিলাল সাহা, কৃষ্ণচন্দ্র, রাম, নির্মল, বিমল, মহেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন। কাউখালীর সুভাষ চন্দ্র দত্তকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাকবাহিনী। পিরোজপুর সদর থানার তেজকাঠী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালের তীরে এক সঙ্গে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্য সভায় বলেন, আমরা অবশ্যই বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা চাই, তবে বাংলাদেশের কবর রচনা করার কিংবা গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের নিষ্ক্রিয় করার অধিকার আমাদের নেই। ভারত সে ধরনের মীমাংসার আশাও করে না। আমরা শরণার্থীদের সীমান্তের ওপারে বর্বরতার মুখে ঠেলে দিতে পারি না, যেখান থেকে প্রাণভয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কানাডার অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মিজেল শার্প তার দেশের কমন্স সভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্ভূত পরিস্থিতির রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর এই রাজনৈতিক মীমাংসার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দিন নিউইয়র্ক টাইমস এ ’ভয়ঙ্কর দুর্যোগ’ শিরোনামে প্যারিস থেকে সি এল লুসবার্গারের পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভয়ঙ্কর হত্যাকা-ের জন্য হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা আমরা ভুলিনি। সংখ্যার দিকে প্রায় সমানুপাতিক হ্যাম্বার্গ আর ড্রেসডেনের কথা আরও সহজে ভুলে যাচ্ছি। সেগুলোকে গতানুগতিক ধরেছি আমরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্যোগ দেখা যেতে পারে। এখানকার দুর্যোগ মানুষের সহানুভূতিমাপক যন্ত্রে পরিমাপযোগ্য নয়। ঠিক কত জন প্রতিদিন নিহত-আহত হচ্ছে, নিখোঁজ হচ্ছে, গৃহহীন হচ্ছে তা কারও পক্ষে গণনা করা সম্ভব নয়। এদিন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জুনের ১০ তারিখ থেকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট, পাকবাহিনীর নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের পর গেরিলারা ময়মনসিংহ, বরাগপাড়া প্রভৃতি জেলার সীমান্তফাঁড়ি দখল করে নিয়েছে। ঢাকার একটি হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুক্তিবাহিনী, যার ফলে কিছু পাকিস্তানী আর্মির সহযোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আহত হয়। জুনের ১০ তারিখে রাজশাহীতে একটি পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়িতে আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। পরদিন মুক্তিবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের কাছাকাছি একটি এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। তারা একই সঙ্গে হামলা চালিয়েছে রংপুর এবং গাইবান্ধাতেও। চিলমারি এলাকায় গেরিলারা একটি পাকিস্তানী জীপে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে এবং এর যাত্রী পাকিস্তানী সেনাদের হত্যা করে। তারা হিটিবান্ধা এলাকার রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং রংপুর ও গাইবান্ধা এলাকার মধ্যবর্তী টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সিলেট সেক্টরে গেরিলারা বড়গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান আর্মিদের একটি দলের ওপর মর্টার হামলা করে, এর ফলে দলের কতিপয় সেনা নিহত হয়। দৈনিক কালান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাক সামরিক চক্র বাংলাদেশে জাতিগত হত্যার ঘৃণ্য অপরাধ চাপা দেয়ার জন্য ইসলামিক দেশ বিপন্ন বলে যে ধুয়া তুলেছে তা আরব দেশের জনগণকে প্রতারিত করতে পারবে না বলে এখানে আরব দেশের ৫টি যুব সংস্থা এক যুক্ত বিবৃতি প্রচার করেছে। আরব দুনিয়া থেকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর ইয়াহিয়ার আক্রমণের প্রতিবাদে এই প্রথম বিবৃতি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চমকপ্রদ জয় বর্ণনা করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে দেবার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অনুরোধে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ওপর জাতিগত হত্যা শুরু করেছে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা এবং ইয়াহিয়ার সামরিক বর্বরতা দেশের ঐক্যের ওপর প্রচ- আঘাত হেনেছে। বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামরত যুবকদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য সংহতিমূলক প্রচার সংগঠিত করার এবং সামরিক শাসকের জাতিগত হত্যার মুখোশ খুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে আরব দেশের যুবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে সিরিয়ার ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইরাকের ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়ন, ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আসসালাফি যুব আন্দোলন, সুদানের যুব ইউনিয়ন, লেবানন ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেছেন। জানা গেছে, যে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের যুব সংস্থার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগত উপরোক্ত আরব যুব সংস্থার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয় যুব ফেডারেশন ও যুব কংগ্রেসের সর্বশ্রী যোগীন্দ্র সিং দয়াল ও জনার্দন সিং আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আরব দেশের যুব সমাজের পক্ষ থেকে ঐ মর্মে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ু থেকে পশ্চিমবাংলা অনেক দূরে অবস্থিত হলেও বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নজিরবিহীন প্রবাহ এখানেও অব্যাহত আছে। এখানকার মানুষও ইয়াহিয়া খানের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এখানকার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিলম্বের কারণে ভারত সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছে স্থানীয় নেতারা। ফণীভূষণের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বাংলাদেশী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মর্মান্তিক পরিস্থিতি এখানকার মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য তিন দিনের সফরে এই শহরে এসেছেন। জনাব মজুমদার আশা প্রকাশ করেছেন যে শরণার্থীদের এই প্রবাহ ভারতের সচিব পরিষদে উত্থাপিত হবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের আরেকজন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিনিধি রয়েছেন। শরণার্থীর সংখ্যা আরও নিয়ন্ত্রত করা সম্ভব যদি না ভারত সরকার বাংলাদেশ এবং শরণার্থীদের স্বীকৃতি প্রদান করেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×