ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ১ আষাঢ়

এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে/এসো করো স্নান নবধারাজলে...

প্রকাশিত: ১০:৩১, ১৫ জুন ২০১৯

এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে/এসো করো স্নান নবধারাজলে...

সমুদ্র হক ॥ ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি। কখনও মুষল ধারায়, কখনও ছিটেফোঁটা। আকাশ এই মেঘলা এই রোদেলা। গরম কাটছে না। বলাবলি হচ্ছে আষাঢ় কি আসেনি! বর্ষা আসবে কবে? সময় মতোই দুয়ার ঠেলে ঢুকে মৃদু হাসি দিয়ে বলেছে- এসেছি তো। সঙ্গে বৃষ্টিও এনেছি। বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি! রোমান্টিকতার বিচ্ছেদও চোখে পড়ছে। ঈষাণ কোণে লুকিয়ে থাকা ছাই রঙের মেঘ সুর তুলেছে -বিচ্ছেদের। ছন্দ লয়ে এবার বর্ষার মিলন পূর্ণ হবে। আবহাওয়া বিভাগ যে আভাস দিচ্ছে তাতেও বর্ষার সেই রূপ ফুটে উঠবে। বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। রূপসী তরুর নীপ বনে ফুল (কদম) ফুটেছে। ছায়াবীথি তলে আষাঢ়ের সুর। আকাশ মেঘ বাদলের। এবারের বর্ষা বোধকরি ভাব নিয়েই আসছে। গত ক’বছর বর্ষা ছিল দুর্বল। এবার আষাঢ় কি রূঢ় আচরণ করবে! আবহাওয়া বিভাগের আভাস বর্ষার অনুকূলে। বঙ্গোপসাগরে মৌসুমের একাধিক নিম্নচাপের সম্ভাবনা। ভারি বৃষ্টির শঙ্কা উত্তর-উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। বৃষ্টির পর সাধারণত তাপ কমে। এবার উল্টো। সঙ্গে নিয়ে এসেছে ভ্যাপসা গরম হাঁসফাঁস অবস্থা। শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়ায়ে উর্ধমুখে নর-নারী। বর্ষা কতটা মধুর-বেদনার আর কতটাই বা রোমান্টিক! বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালীর কত যে ঋতু বন্দনা। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতিতে মানবমানবীর হৃদয়ের আবেগের ধারা তৈরি করেছেন, যেখানে চোখের জলও ভাললাগার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলা কাব্যে সাহিত্যে সঙ্গীতে বর্ষাকে নিয়ে যত গান যত কবিতা যত গল্প যত উপন্যাস অন্য কোন ঋতু নিয়ে এতটা নেই। বর্ষার এই ধারা গীতিকারদের সুর তুলে দিয়েছে। সতীনাথের কণ্ঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিম ঝিমরিম ঝিমঝিম গান গেয়ে যাই’... মান্না দে’র কণ্ঠে ‘ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে’.... হেমন্তের কণ্ঠে ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’... লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো তো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষা হাওয়া হিম হিম হিম পরসা’ সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষারও প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়’...। বর্ষার বাদল দিনে এসব গান হৃদয় বীণায় আকুতি জাগায় সুর তোলে। বর্ষার কাব্যধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ীদাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতা মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ মেঘকে ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে। বর্ষায় আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্ণের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেক পারেই রঙধনু। কালিদাসের বর্ণনায় রেবা নদীর তীরে বর্ষার দিনে মালবিকা প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় ছিল। এর মধ্যেই হলুদ বরণ গায়ক দল হেঁড়ে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তুলে বর্ষার বারতাই জানিয়ে দেয়। বর্ষার সত্তা ঘিরে আছে মানুষের জেগে ওঠার, সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান। নদ নদী ফুলে ফেঁপে রুদ্ররূপ ধারণ করলে নদী তীর ও চরগ্রামের মানুষ জেগে ওঠে অস্তিত্ব রক্ষায়। মাটির বাঁধও যখন রক্ষা করতে পারে না তখন মানব জীবনের সঙ্গে পশুপাখির জীবন রক্ষার তাগিদও মানবিক গুণাবলীতে যোগ হয়। তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার বৈঠা ঠেলে ভাঙ্গন কবলিত মানুষ পাড়ি দেয় শুকনো ভূমির আশ্রয়ে। ভালবাসার বন্ধনে নদীভাঙ্গা মানুষ একাকার হয়ে যায়। বর্ষার কালো মেঘের মধ্যেই দেখা মেলে এক অরুণ আলোর। বর্ষায় অনুষঙ্গ যাই থাক বৃষ্টির সুর মানব-মানবীর হৃদয়কে মধুছন্দে নাচিয়ে তোলে। গ্রামে টিনের চালাঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ধ্রুপদী সুর তোলে। বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ছাতা নিয়ে বেড়ানো সে আরেক ছন্দ। এই ছাতা বছরের অনেকটা সময় ঘরের কোণেই থাকে। ধুলোও জমে। সেই ধূলির পরতে ভরা বস্তুটি বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। ছাতা মেরামতের কারিগর টাইকরদের মৌসুম এই বর্ষাকাল। বর্ষায় গ্রামের কিশোররা ঠেলা জাল নিয়ে নামে মাছ ধরতে। কিশোর-কিশোরী হাঁটু জল পেরিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি যায়। তরুণরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢলের জলে। আগের দিন যেখানে ছিল শুকনো সড়ক রাতভর বৃষ্টিতে সেই সড়ক ডুবে গেলেই ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। ‘বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল করেছ দান...’ কবিগুরু কদমকে এভাবে ব্যঞ্জনা দিয়েছেন গানের সুরে। গ্রামীণ জীবনের এই ধারার পাশে নগর জীবন আরেক ধারার। যেখানে বৃষ্টি দুর্ভোগ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হলেই ভোগান্তির মাত্রা যায় বেড়ে। খ-কালীন বন্যার রূপ নেয় মহানগরী। স্তব্ধ হয়ে পড়ে সব কিছুই। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম বন্ধুর পথ। তবুও জীবন থেমে থাকে না। বর্ষার এমন জীবনেই মানুষের পথ চলা- ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে...’।
×