ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বারো জঙ্গীর টার্গেট হাইকোর্ট, শিশুপার্ক শিল্পকলা, ঢাকা ক্লাব

প্রকাশিত: ১০:২৮, ১৫ জুন ২০১৯

  বারো জঙ্গীর টার্গেট হাইকোর্ট, শিশুপার্ক শিল্পকলা, ঢাকা  ক্লাব

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারির আগে শিশু পার্ক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে ভয়াবহ হামলার চেষ্টা করেছিল একটি আত্মঘাতী জঙ্গী স্কোয়াড। স্কোয়াডটি গঠন করা হয়েছিল বারো জঙ্গীর সমন্বয়ে। স্কোয়াডটির তিন জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা তথ্য দিলে হয়তো হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা এড়ানো সম্ভব হতো। পলাতক নয় জঙ্গীর একজন হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় অংশ নেয়ার পর কমান্ডোদের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়। আরেক জঙ্গী কল্যাণপুরে চালানো অভিযানে নিহত হয়। এখনও সাত জঙ্গী পলাতক। মোস্টওয়ান্টেড এই সাত আত্মঘাতী দুর্ধর্ষ জঙ্গী গ্রেফতারে গত চার বছর ধরে চেষ্টা চলছে। বারো জঙ্গীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ ওই স্কোয়াডটির হামলার টার্গেট উচ্চ আদালত, শিশু পার্ক, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা ক্লাব ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। এজন্য নতুন করে কয়েকটি স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাত্র আধঘণ্টার হেরফের হলেও হলি আর্টিজানের চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারত শিশু পার্ক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেই ঘটনাটি কোন দিনই প্রকাশ করা হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে। ওইদিন শত শত সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযানে জঙ্গীদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অভিযানে ধরা পড়া তিন জঙ্গীকে মাসের পর মাস ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা কোন তথ্য দেয়নি। তিন জঙ্গী তথ্য দিলে হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার ঘটনা হয়তো এড়ানো সম্ভব ছিল। শিশু পার্ক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর মাত্র প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যেই জঙ্গীরা গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলা চালায়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১৩ সালের পর থেকেই জঙ্গীদের বিষয়ে বিশেষ মনিটরিং চলছিল। সেই মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে কারাগারে ও পলাতক থাকা জঙ্গীদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছিল। এরই মধ্যে জঙ্গীদের ঢাকায় বড় ধরনের হামলা করার তথ্য মিলে। সেই তথ্যের সূত্র ধরে চলতে থাকে গোয়েন্দাগিরি। তার সফলতাও আসে। দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। জানা যায়, কিছু জঙ্গী ঢাকার শিশু পার্কসহ আশপাশের এলাকায় হামলার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার চেষ্টা করছে। সে মোতাবেক শুরু হয় অভিযান। সাদা পোশাকে শত শত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। বেলা সোয়া এগারোটা থেকে অভিযান চলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ। ওই অভিযানে গ্রেফতার হয় তিন জন। পরে গ্রেফতারকৃত তিন জনের বিষয়ে রাজধানীর শাহবাগ মডেল থানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল বাশার ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বড় ধরনের নাশকতা চালাতে জঙ্গীরা শাহবাগ শিশুপার্ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কাছে অবস্থান করছিল। এমন তথ্যের ভিত্তিতে বেলা সোয়া এগারোটার দিকে সাদা পোশাকে সেখানে বিপুল পুলিশ অভিযান শুরু করে। অভিযান চলে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত। অভিযানে তিন জন গ্রেফতার হয়। নয় জন পালিয়ে যায়। ওই মামলায় গ্রেফতারকৃত তিন জনকে পরে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্য ও পরবর্তীতে সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাইকৃত তথ্য মোতাবেক গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, রাইয়ান মিনহাজ ওরফে রাইমু ওরফে আরমি (২৪)। তার পিতার নাম মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা ৩১/১ মধ্যবাসাবো, সবুজবাগ, ঢাকা। সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার বড় মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের সেঞ্চুরী মার্কেটের পেছনে সেঞ্চুরী আর্কেডের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করত। অপরজন আহম্মেদ শাম্মুর রাইহান ওরফে চিলার (২৩)। তার পিতার নাম মৃত মফিজ উদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামে। সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার রমনা থানাধীন বড় মগবাজারের ১০৪/১-ক নম্বর অগ্রণী এ্যাপার্টমেন্টের এ-১ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করত। তৃতীয় জন তৌহিদ বিন আহম্মেদ ওরফে রিয়াজ ওরফে কাচ্চি (২৪)। পিতার নাম শহিদুল্লাহ আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানাধীন রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। সে ঢাকার বনানীর ডি ব্লকের ১৩ নম্বর সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক অভিযানকালে কৌশলে নয়জন পালিয়ে যায়। তারা গোয়েন্দাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে হেঁটে পালিয়ে যায়। পলাতক নয় জন হচ্ছে, নিবরাজ ইসলাম ওরফে শিমু (২৪), সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো (২৪), তৌসিফ (২৪), সাবাব সালাউদ্দিন ওরফে হক ওরফে ইনু (২৫), সালভি আলী ওরফে মালাভি (২৫), রিফাত (২৩), তুরাজ (২৪), ইয়াসিন তালুকদার (২৫) ও গালিব (২৭)। পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের ওই কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গীর দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আরও জানান, মোট বারো জঙ্গীর সমন্বয়ে একটি বিশেষ স্কোয়াড গঠন করা হয়েছিল। স্কোয়াডটির টার্গেট ছিল ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানো। তারা উচ্চ আদালত, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, শিশুপার্ক, শিল্পকলা একাডেমি ও ঢাকা ক্লাবকে হামলার টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। হামলার প্রথম টার্গেটের তালিকায় ছিল শিশুপার্ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট। হামলা চালাতে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই স্কোয়াডটি শিশু পার্ক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ পুরো এলাকা রেকি করেছিল। পলাতকদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহতভাবে চলছিল। গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গীকে মাসের পর মাস জেরা করা হয়েছে। তারা ঢাকায় হামলা সম্পর্কে ধারণা দিলেও কবে কোথায় কখন হামলা হবে, সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছে। ফলে হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা সম্পর্কে আগাম কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। গ্রেফতারকৃত তিন জন জানিয়েছিল, ধাপে ধাপে তাদের হামলা চালানোর পরিকল্পনা আছে। একটি হামলা সফল হওয়ার পর, দীর্ঘ সময় নিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের আরেকটি হামলা চালানোর পরিকল্পনা আছে। জঙ্গী গ্রেফতারে চলমান সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঘটে যায় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার ঘটনা। হামলায় জঙ্গীদের হাতে নিহত হন বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। এছাড়াও জঙ্গীরা ১৭ জন বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গীর মৃত্যু হয়। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন তিন বিদেশীসহ ১৩ জিম্মিকে। সবমিলিয়ে আগে ও পরে হলি আর্টিজান থেকে জিম্মি দশা থেকে ৩৩ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে নিহত আত্মঘাতী পাঁচ জঙ্গীর একে একে ছবি প্রকাশ করা হয়। হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। প্রকাশিত সেই ছবি দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। কারণ শিশু পার্ক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে যে ৯ জঙ্গী পালিয়ে গেছে তাদেরই একজন নিবরাজ ইসলাম। পরে জানা যায়, নিবরাজ ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ছিল। হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীদের অন্যতম ছিল নিবরাজ। এরপর পুরো ঘটনাটি পরিষ্কার হয়ে যায়। পরবর্তীতে আরও জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য মোতাবেক ধারণা করা হয়, বারো জনের স্কোয়াডটি হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়টি আগ থেকেই জানত। শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গী ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতার চালানোর পরিকল্পনার কথা জানালেও, হামলার টার্গেট সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি। টার্গেট সম্পর্কে তথ্য দিলে হয়তো গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার হামলা ঠেকানো সম্ভব হতে পারতো। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর জাহাজ বিল্ডিংয়ে পুলিশের অভিযানে নয় জঙ্গী নিহত হয়। ইকবাল নামের এক জঙ্গী পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান নামের এক জঙ্গী। নিহত নয় জঙ্গীর মধ্যে আট জনের পরিচয় নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নিহত নয়জনের মধ্যে একজন শাহবাগ থেকে পালিয়ে যাওয়া সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক। অর্কও হলি আর্টিজান ও হলি আর্টিজানের ছয় দিন পর শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলার ঘটনাটি জানত বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। অর্কের পরিচয় ও পুরো ইতিহাসটি জানার পর রীতিমত হতবাক হওয়ার অবস্থা। কারণ শাহবাগে হামলা চালাতে আসা বারো জঙ্গীই গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলা সম্পর্কে জানত। অর্কের পিতার নাম তৌহিদ রউফ। অর্ক পরিবারের সঙ্গে ৬২ পার্ক রোড, বাসা নং-৩০৪, রোড নং-১০, ব্লক-সি, ফ্ল্যাট নং-৯, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, থানা-ভাটারা, ঢাকায় বসবাস করত। সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে বিভিন্ন সময় দাবি করা হয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। অর্ক বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর শিক্ষার্থী ছিল। র‌্যাব সর্বশেষ ৬৮ জনের নিখোঁজের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেই তালিকার দ্বিতীয় নম্বরেই নাম ছিল অর্কের। অর্ক নিখোঁজের বিষয়ে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিল তার পরিবার। নিরবাস ও অর্কের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর গুলশানের হলি আর্টিজানে ২২ জনকে হত্যাকারী পাঁচ জঙ্গী এবং কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয় জঙ্গী, পলাতক এক জঙ্গী এবং আহত অবস্থায় গ্রেফতার থাকা হাসান একই গ্রুপের সদস্য বলে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়।
×