ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আজ

ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না ...

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৫ জুন ২০১৯

 ওগো বৃষ্টি আমার  চোখের পাতা  ছুঁয়ো না ...

মোরসালিন মিজান ॥ ‘যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা।/তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না,/আমার বাদলের গান হয় নি সারা...।’ বাদলের গান, না, সারা হয়নি। সবে শুরুটা হলো। এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা...। বাঙালীর খুবই প্রিয় ঋতু বর্ষা এসেছে। আজ শনিবার ১ আষাঢ়, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু বর্ষার। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। প্রথম মাসের প্রথম দিনে আজ প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেবে বাঙালী। থাকবে নানা আনুষ্ঠানিকতা। রাজধানীতে আয়োজন করা হবে বর্ষা উৎসবের। ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের/পাতা ছুঁয়ো না,/আমার এতো সাধের কান্নার দাগ/ধুয়ো না,/সে যেন এসে দেখে,/পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি...।’ এরই মাঝে কাঁদতে শুরু করেছে আকাশ। ক্রমে নতুন প্রাণ পাচ্ছে প্রকৃতি। গ্রীষ্মের অসহনীয় গরম থেকে মুক্তির আভাস দিচ্ছে বর্ষা। কবিগুরুর বর্ণনায়: তোমার মন্ত্র বলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা...। নজরুলের ভাষায়: রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে...। ভাঁটি বাংলার লোককবি উকিল মুন্সি আরও আবেগী। গানে গানে তার বলাটি এ রকম- যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। মনের গভীর গোপন কথাগুলো নতুন করে জাগিয়ে দিতে এসেছে বর্ষাকাল। অবশ্য আজ আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও, গত কয়েকদিন ধরেই কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে মূলত বর্ষার আগমন ঘোষণা করছিল প্রকৃতি। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্ষায় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয়। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের আভাস। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। এ সময় ধুলোজমা প্রকৃতি তার শরীর ধুয়ে নেয়। পরিচ্ছন্ন হয়। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ বর্ষার চিত্তচাঞ্চল্য প্রকাশ করে কবিগুরু লিখেছেন- হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে...। ময়ূরের মতোই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যতœ করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইত রূপ! মানুষের মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগায় বর্ষা। প্রেমের বোধ উস্কে দেয়। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়- তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/ কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। একই রকম অনুভূতি থেকে নজরুল লেখেন- রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/ জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতা থেকে জাতীয় কবি নজরুল আরও লেখেন: চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়। পুরনো বিয়োগব্যথা বুকে বাজে। অভিন্ন অনুভূতির কথা জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমনদিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ গেয়ে গেছেন: প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এ রকম- বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীর: শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। কবি অন্যত্র লেখেছেন, অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...। এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। আলাদা করে বলতে হয়, হাওড় এলাকার কথা। বর্ষায় হাওড়ের চেহারা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জলের নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে চাষী, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাঁটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাঁটির বাউল উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেন, গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে...। বর্ষায় এসব অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের প্রচলন আছে। নৌকো করেই বর যায় বিয়ে করতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা এই সাত জেলার লোক কবিরা বর্ষায় বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁদের কালজয়ী সৃষ্টিই সে কথা বলে। অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য এমন নয়। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারাবছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়, শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিম সে অবস্থা তুলে ধরে গেয়েছেন, আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/ বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো নিত্যদিনের। বর্ষার কাছে তাই প্রার্থনা: ‘এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...।’ বর্ষা উৎসব ॥ প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীতে নানা আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আজ সকালে চারুকলার বকুলতলায় বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। আলাদা আলাদা তারিখে বর্ষা বন্দনা করবে ছায়ানট, উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠন।
×