ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষমো হে মম দীনতা’...

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৪ জুন ২০১৯

 ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষমো হে মম দীনতা’...

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘ক্ষমাকে’ বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ‘প্রশ্ন’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে, তারা বলে গেল “ক্ষমা করো সবে’...। এ কথা বলে তিনি ক্ষমাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। ঠিক তার বিপরীতেই তিনি আবার ন্যায়দ- কবিতায় লিখেছেন- ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।’ শ্যামা নৃত্যনাট্যেও বজ্রসেনের কণ্ঠ দিয়ে যে কথা শুনিয়েছেন তা হলো ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষমো হে মম দীনতা’। এই দুই স্থানে গুরুদেব নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছেন যে, সব অপরাধীকে মানবসন্তান ক্ষমা করতে পারে না, এমনকি বিধাতা ক্ষমা করলেও। ওপরের কথাগুলো উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, সম্প্রতি এয়ার মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, যিনি ’৭১-এ একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সম্প্রতি জাতির কাছে এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ক্ষমা প্রার্থনার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তার রচিত বই ‘১৯৭১-ভেতরে বাইরে’-এর ৩২ পৃষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের যুগান্তকারী ভাষণকে বিকৃত করে প্রকাশ করেছেন। খন্দকার সাহেব সেই বইয়ে লিখেছেন- বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’র পরে পরেই ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন। সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার সাহেব স্বীকার করলেন যে, তিনি এটা লিখে মারাত্মক ভুল করেছেন, যা তার জীবনে কয়েকটি মারাত্মক ভুলের অন্যতম। তিনি আরও বলেছেন, যে করেই হোক কথাগুলো তার বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে গেছে এবং তাই ৯০ বছর বয়সে, অর্থাৎ তার জীবন সায়াহ্ণে এসে তিনি এই ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। কবিগুরুর আরও একটি কবিতা মনে পড়ে গেল ‘আমার বেলা যে যায়, সাঁঝ বেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মিলাতে’। জীবনের গোধূলি বেলায় অর্থাৎ মানুষ যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে বলে মনে করে, তখন অতীতের অপরাধমূলক ক্রিয়াকর্ম তাকে অনুতপ্ত করে তোলে, সে সত্য কথা বলে, ক্ষমাপ্রার্থী হয়। অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াশ হিসেবে অর্থাৎ অতীতে গাওয়া বেসুরা গান পরিহার করে নিজেকে সুরের আওতায় নিয়ে আসতে চায়। আইনেও এ ধরনের তত্ত্ব রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি মৃত্যুকে আসন্ন মনে করে যদি কোন বক্তব্য দেয় তাহলে সেই বক্তব্যকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তবে এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার এরপরও কিন্তু পুরোপুরি খোলা মন নিয়ে তার কথা ব্যক্ত করেননি। তার ভাষ্য তিনি ভুল করেছেন। তিনি যে অসত্য বা আরও সোজা ভাষায় মারাত্মক মিথ্যা কথা বলেছেন তা বলেননি। সেটা বললে কিছু লোক কিছুটা হলেও তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারত। তিনি সম্ভবত জীবনের শেষ সময়ে নিজেকে সরাসরি মিথ্যাবাদী হিসেবে উপস্থাপন না করে বরং কিছুটা চতুরতার ভূমিকা পালন করেছেন ‘মিথ্যার’ বদলে ‘ভুল’ শব্দটি ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের কৌতুক নাটক ‘এনায়েত আলির ছাগল’ দেখলাম, যেখানে স্থানীয় এলাকার নিন্দিত চেয়ারম্যান অবশেষে তার জীবনের সমস্ত পাপাচারের জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে। জনগণ তাকে ক্ষমা করেনি এই ভেবে যে, এই ক্ষমা চাওয়ার পেছনে তার ভ-ামির নতুন নীলনকশা রয়েছে। তবে সেই এনায়েত আলি তখনও মধ্যবয়সী, বার্ধক্যের ভারে নতজানু ছিলেন না। এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার যখন বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লিখিত কথাটি লিখেছেন, তখন তার বয়স আশির দশকের মাঝামাঝি। বিলেতে আমার এক ইংরেজ মনস্তাত্ত্বিক বন্ধু, যিনি সিগমন্ড ফ্রয়ডের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ব্যক্তির উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন- বয়স যখন ৮০-র মধ্যভাগে তখন অনেক মানুষের মধ্যে, তার ভাষায় ভিমরতি দেখা দিতে পারে বলে সিগমন্ড ফ্রয়ডও মনে করতেন। সে বয়সে অনেকেই সুস্থ চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, জীবনে কি পেলেন আর কি পাননি তার হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হয়ে সামান্য লোভ-লালসার কাছে পরাজিত হয়ে যান। লোভ চরিতার্থ করার জন্য অনেক অচিন্ত্যনীয় কাজ করে ফেলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারেরও তাই হয়ে থাকতে পারে। নইলে কেন তিনি জাতির স্থপতির ভাষণ এমন নির্লজ্জের মতো বিকৃত করলেন। তিনি নিশ্চয়ই প্রলোভন সামলাতে না পেরেই এটি করেছিলেন। ’৭১-এর ৭ মার্চ আমি লন্ডনে ছাত্র। তথাপিও সেখানে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক জড়িত ছিলাম বলে এই যুগ সৃষ্টিকারী ভাষণ নিজ কানে শোনার সুযোগ আমার ৭ তারিখেই হয়েছিল। আমি তখন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৫ নং আহ্বায়ক। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম নেয়া এই সংস্থা ছিল বিলেতে বাংলাদেশ আন্দোলনের জন্য সৃষ্ট প্রথম সংস্থা। এই সংস্থার বিভিন্ন কার্যকলাপে পরামর্শ দিতেন দু’জন গুরুজন। এদের একজন ছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রয়াত সিরাজুর রহমান এবং অন্যজন বিশিষ্ট গ্রন্থকার ও বঙ্গবন্ধু গবেষক প্রয়াত আবদুল মতিন, যিনি ব্রিটিশ সরকারের রেইস রিলেসন্স কমিশনে উঁচু পদে চাকরিরত ছিলেন। ৮ মার্চ আমরা অর্থাৎ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস দখলের সিদ্ধান্ত নেই। কয়েক সহস্র লোকও জড়ো করতে পেরেছিলাম। তবে ৭ তারিখেই স্থির করলাম সিরাজুর রহমানের বিবিসি স্টুডিওতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ আমরা আগে শুনব। ঢাকা-লন্ডন সময়ের ব্যবধান তখন ৫ ঘণ্টা। তাই ৭ তারিখ রাতের বেলায় সিরাজুর রহমানের সহায়তায় বুশ হাউসে বিবিসি স্টুডিওতে গিয়ে পুরো ভাষণটিই আমরা শুনেছি। অন্যদের মধ্যে ছিলেন জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা সুলতান শরিফ, জনমত সম্পাদক প্রয়াত ওয়ালি আশরাফ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ২ নং আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ (বর্তমানে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ) ছিলেন কিনা মনে নেই, তবে বিবিসির প্রয়াত কমল বোস, প্রয়াত শ্যামল লোধ, রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত), ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসান ও (পরে ড. ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসান) ছিলেন। ভাষণের কোথাও ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ দুটি আমরা শুনতে পাইনি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতার পর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হয়নি বলে সিরাজুর রহমান গণেশ উল্টে দিয়েছিলেন বটে, তবে ’৭১-এর পুরো সময়টা তিনি আন্দোলনের পক্ষেই ছিলেন এবং তিনি কাজ করেছেন যুক্তরাজ্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। তিনি এবং মতিন সাহেব বহু বিষয়ে আমাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এক দশকের অধিককাল আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠিত ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণ ওয়াচডগ সংস্থা যুক্তরাজ্যে ইমিগ্রেশন এ্যাডভাইজরি সার্ভিসের বিভিন্ন পদে (শেষ অবস্থায় আইনী পরিচালক পদে) চাকরিরত থাকার কারণে দু’জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল শফিউল্লা এবং লে. জেনারেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে, যারা উভয়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে প্রয়াত সৈয়দ রেজাউল হায়াতের সঙ্গে, যিনি লন্ডনের দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার ছিলেন। তাদের তিনজনই ৭ মার্চের ভাষণ মুখস্থ বলতে পারতেন। তারা কখনও বলেননি বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে চাকরিতে থাকলেও জেনারেল শফিউল্লা এবং মীর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছেন। সৈয়দ রেজাউল হায়াতও শুনেছেন, যিনি তখন কোন এক জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং পরে পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। আমার পরিবারের অনেকেই সেদিন রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আমার প্রয়াত ভগ্নিপতি অধ্যাপক শামসুল হুদা, যিনি ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে দু’বারই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে যথাক্রমে গণপরিষদ এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জ থেকে। তিনি রোকেয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জিনাত হুদার পিতা এবং নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান চানের শ্বশুর। এ ছাড়া আমার অগ্রজ ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, যিনি শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন ছিলেন। তিনিও ছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। অধ্যাপক শামসুল হুদা অবশ্য এখন প্রয়াত; কিন্তু আমার বড় ভাই বলছেন বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন বলে যারা বলে তাদের নিশ্চয়ই মতিভ্রম ঘটেছে। লে. জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল ইসলাম হলেন আরেক ব্যক্তি যিনি রেসকোর্সে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। এই ভদ্রলোক অবসরের পূর্বে চীফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের অনুজ এবং সেই সুবাদেই আমার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তিনি বলেছেন, তখন তিনি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। তবুও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার লোভ সংবরণ করতে পারেননি বলে সেই বয়সেই তার শান্তিনগরের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। তিনিও অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলেই তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন বলে যারা বলে তারা নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই তা বলছেন, সত্যকে বলি দিয়ে। আরও এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা যিনি প্রত্যক্ষভাবে এ ভাষণ শুনেছেন, তিনি হলেন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক প্রধান লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। আত্মীয়তার সুবাদেই তার সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি তা হলো এই যে, কেউ যদি বলে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ও বলেছিলেন তাহলে তিনি হ্যালুসিনেশন (Hallucination) আক্রান্ত রোগী বৈ কিছু নন। এমনি আরও শত শত উদাহরণ দেয়া যাবে তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে, যারা রেসকোর্সে উপস্থিত থেকে ভাষণটি শুনেছেন। খন্দকার সাহেবের নিজের কথা অনুযায়ীই তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনেননি, তিনি অন্যের মুখ থেকে শুনেছেন, সাক্ষ্য আইনের ভাষায় যাকে ‘হিয়ারসে’ বলা হয়। তাছাড়া তিনি আরও একটি অসত্য কথা লিখেছেন। তিনি ব্যক্ত করেছেন, তিনি ৭ তারিখেই রেডিওর মাধ্যমে ভাষণটি শুনেছেন। সত্য কথা হলো এই যে, ভাষণটি বেতার মারফত ৭ তারিখে প্রচার হয়নি, প্রচার হয় পরদিন, অর্থাৎ ৮ মার্চ। ৭ মার্চ বিবিসির বিশ্ব সার্ভিসসহ অন্যান্য বেতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হয় শীর্ষ এবং প্রথম খবর হিসেবে। লন্ডনের টেলিভিশনগুলোতে শীর্ষ এবং প্রথম সংবাদ হিসেবে ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা। সব খবরেই বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলে তাঁর ভাষণ শেষ করে বস্তুত স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাই দিয়েছেন। পরদিন লন্ডন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সব পত্রিকাতেই শীর্ষ সংবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আর সব পত্রিকারই ছিল একটি কথা, যা হলো এই যে, ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণ শেষ করে বঙ্গবন্ধু মূলত বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ বলেই উল্লেখ করেছেন। ৮ মার্চ বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ খবরের শিরোনাম ছিল, যা বাংলায় তরজমা করলে বলা যায় ‘রাজনীতির কবি’। বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ প্রতিকৃতিসহ ছাপানো সেই খবরেও বলা হয় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ‘জয় বাংলা’ ঘোষণা দিয়ে। যুক্তরাজ্যের টাইমস পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় ‘জয় বাংলা’ আর স্বাধীন বাংলার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। টাইমস পত্রিকার খবরটি পাঠিয়েছিলেন সে সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক পিটার হেজেলহার্স্ট। জাতির স্থপতি সম্পর্কে মিথ্যাচার করে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যা এখন বিশ্বের ঐতিহ্য হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে, বিকৃত করে খন্দকার সাহেব কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছেন তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে সামান্য লোভের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি যা হারালেন তা ছিল অমূল্য রতন। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহানুভবতার বিশাল ভা-ারসম। তাঁর হৃদয় ছিল মহাসমুদ্রের মতোই গভীর। এত বড় ক্ষমাশীল এবং করুণাময় ব্যক্তি সারা বিশ্বেই বিরল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আত্মা এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারকে ক্ষমা করবেন কি-না সে কথা তো আর ইহজগতের মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে যতটুকু আন্দাজ করতে পারি তা হলো এই যে, মর্ত্যবাসী বাঙালী জনতা খন্দকার সাহেবকে ক্ষমা করার প্রবণতা নিয়ে দেখতে নারাজ। তিনি যেনতেন কাউকে নয়, সেই মহামানবকে অবমাননা করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন, যিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা না করলে খন্দকার সাহেব একজন এয়ার ভাইস মার্শাল হতেন না, কেউ তার নামও জানত না, তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে অবসরে গিয়ে অখ্যাত মানুষ হিসেবে জীবন কাটাতেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, খন্দকার সাহেব কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? মানুষের বিবেক যদি সবচেয়ে বড় বিচারালয় হয় তবে এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে খন্দকার সাহেব নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। সেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের মতোই অন্তরের তুষের আগুনে তিনি জ্বলে-পুড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবেন বাকি জীবন। মীর জাফর এবং রবার্ট ক্লাইভের শেষ জীবনে যা হয়েছিল খন্দকার সাহেবের অবশিষ্ট জীবনেও তাই ঘটবে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম, ইতিহাসের কথা। মুক্তিযুদ্ধের একজন ক্রান্তি বীর হিসেবে যে ব্যক্তি প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালীর হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকতেন, ইতিহাসে যার নাম লিপিবদ্ধ হতো স্বর্ণাক্ষরে, পার্থিব কিছু লোভের কারণে সে ব্যক্তি অনন্তকাল গণধিক্কারের পাত্র হয়ে থাকবেন। ইতিহাসে তার পরিচয় হবে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। তার নাম লিখা হবে বিশ্বাসঘাতকের পাশাপাশি। তার বিবেক তাকে দগ্ধ করবে প্রতিটি মুহূর্তে। তিনি সম্ভবত এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই অবশেষে গণক্ষমা প্রার্থনার পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তি যে বড়ই নির্মম হতে পারে! লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×