ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রী নিজেই বাজেট উপস্থাপন করলেন

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৩ জুন ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী নিজেই বাজেট উপস্থাপন করলেন

সংসদ রিপোর্টার ॥ দেশের সংসদীয় ইতিহাসে একটি অনন্য নজীর সৃষ্টি হলো। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অসুস্থ্যতার কারণে জাতীয় সংসদে তাঁর পক্ষে বাজেটের বড় অংশই উত্থাপন করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। সংসদীয় ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনায় অংশ গ্রহণের ঘটনা এই প্রথম। বিকাল ৪ টা ১০ থেকে ৪টা ৪০ পর্যন্ত ৩০ মিনিটব্যাপী অবশিষ্ট বাজেট বক্তব্য শেষ করলে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা দীর্ঘক্ষণ টেবিল চাপড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। তবে হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদে এসে প্রচন্ড অসুস্থ্য অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল প্রথম এক ঘন্টা নিজেই বাজেট উপস্থাপন করেন। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় হলুদ শাড়ী পরা স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। বাজেট পেশ উপলক্ষে অধিবেশন কক্ষ ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। সংসদ গ্যালারি থেকে ভিআইপি লাউঞ্চ সর্বত্রই ছিল উপচে পড়া ভীড়। বেলা ৩ টা ২৫ মিনিটে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিজের জীবনের প্রথম বাজেট প্রস্তাবনা পড়া শুরু করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ এই শিরোনামে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন শুরু করেন তিনি। প্রচন্ড অসুস্থ্যতার কারণে বাজেট বক্তব্যে উপস্থাপন ঠিককমত করতে পারছিলেন না অর্থমন্ত্রী। পাশ থেকে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী তাঁকে বারবার সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু বিকাল চারটার দিকে একটু বেশিই অসুস্থ্যতা অনুভব করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি ওষুধ গ্রহণের জন্য স্পীকারের কাছে ৫/৭ মিনিটের সময় প্রার্থণা করেন। ওই সময়ে উপস্থিত কয়েকজন চিকিৎসক এমপি এসে তাঁর শারিরীক অবস্থা পরীক্ষা করেন। পরে চোখে ওষুধ দেওয়ার পরও শারিরীক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৫-৭ মিনিট পরে অর্থমন্ত্র্ী নিজেই বাকি বাজেট বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান। এতে অধিবেশনের চিত্রই পাল্টে যায়। সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাকি বাজেট উপস্থাপনের প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের বাকি অংশটুকু উপস্থাপনের জন্য স্পীকারের অনুমতি প্রার্থণা করেন। জবাবে স্পীকার অনুমতি দিয়ে বলেন, ’আপনি দাঁড়িয়ে বা বসে বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন।’ বাজেট উপস্থাপনের জন্য ফ্লোর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’আমাদের অর্থমন্ত্রী খুবই অসুস্থ্য। তাঁর চোখে অপরারেশন হয়েছে, ১৫ মিনিট পর পর তাঁর চোখে ড্রপ দিতে হয়। আমারও চোখে অপারেশন হয়েছে, ঠান্ডা লেগে কথা বলতে গেলে কাশি আসে। এটাই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। তারপরও আপনি (স্পীকার) অনুমতি দিলে বাজেটের বাকিটা আমি উপস্থাপন করবো।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন শুরু করলে তুমুল টেবিল চাপড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। তবে বাজেট বক্তৃতার বইয়ের অনেকাংশেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে কিছু বক্তব্যে ছিল। সেটি পাঠ করার সময় প্রধানমন্ত্রী হেসে স্পীকারকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ’মাননীয় স্পীকার, এটি আমার বক্তব্যে নয়, এটি হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর। বাজেট বক্তৃতায় যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে সেটি আমি পড়বো কি না? জবাবে স্পীকার বাজেট বক্তৃতায় যেভাবে রয়েছে সেভাবেই উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন শেষ করলে স্পীকার বলেন, বাজেটের অপঠিত অংশগুলো পঠিত বলে গণ্য করা হলো। বাজেট বক্তব্যে শেষে প্রধানমন্ত্রী ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে নিজের চোখে নিজেই ড্রপ দেন। সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য, সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতারাও প্রধানমন্ত্রীর আসনের সামনে এসে তাঁর এই দৃঢ়তার ভূয়শী প্রশংসা করেন। রীতিমত উৎসবমুখর পরিবেশ ॥ রীতিমত যেন উৎসবমুখর পরিবেশ। অতীতের মতো কোন রাজনৈতিক দলের বর্জন নয়, বরং নিকট ইতিহাসে সরকার ও বিরোধী দলের সবচেয়ে বেশী রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম ও দেশের ৪৮তম বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুধু অধিবেশনই নয়, দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম এই বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করতে ভিভিআইপি, ভিআইপি, দর্শক গ্যালারী সবকিছু ছিল কানায়কানায় পরিপূর্ণ। দেশের ৪৮তম বাজেট পেশ উপলক্ষে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের সরব উপস্থিতি ছিলো সংসদ অধিবেশনে। উৎসবমুখর পরিবেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল । এরআগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। বাজেট উপস্থাপনের আগে অর্থমন্ত্রী তাঁর হঠাৎ শারিরীক অসুস্থ্যতার কথা উল্লেখ করে কখনো নিজ আসনে বসে এবং দাঁড়িয়ে বাজেট উপস্থাপনের জন্য স্পীকারের অনুমতি চান। স্পীকার তাঁকে অনুমতি দিলে শুরুতেই অর্থমন্ত্রীর অনুরোধে বাংলাদেশ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রমাণ্যচিত্র তুলে ধরা হয়। প্রামাণ্যচিত্রে পাকিস্তান আমলে বাঙালী জাতির ওপর বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চণা, এর বিরদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, পরবর্তী স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সোপানে অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরা হয়। এদিকে বাজেট বক্তৃতার আগেই সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতি বছর বাজেট উত্থাপনের আগে রেওয়াজ অনুযায়ি এই বৈঠকটি সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রীপরিষদে অনুমোদন পাওয়ার পর বাজেট বিলে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। উৎসবমুখর সংসদে বাজেট বক্তৃতা শুনতে আসেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সংসদে নিজ কক্ষে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন তিনি। এরআগে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভবনে স্বাগত জানান সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়াও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিদ্যুত জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল, কূটনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাজেট বক্তৃতা প্রত্যক্ষ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কালো সুটকেস হাতে বেলা পৌনে ৩টায় বাজেট অধিবেশনে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী। প্রচন্ড অসুস্থতা মধ্যেও অর্থমন্ত্রী হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদ ভবনে আসেন। তারপরও তাঁর মুখে ছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু শারিরীক অসুস্থ্যতার কারণে দলের সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতারা তাঁকে সহযোগিতা করতে দেখা যায়। বাজেট বক্তৃতার মাঝে মাঝে সরকারী দলের সদস্যদের সঙ্গে টেবিল চাপড়ে তারাও অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ যোগান। কঠোর নিরাপত্তা ॥ বাজেট পেশ উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় নেওয়া হয়েছিল বাড়তি নিরাপত্তা। বৈধ পাশ ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি সংসদ ভবন এলাকায়। এমনকি দর্শক গ্যালারীতে পাস ইস্যুতেও ছিল কড়াকড়ি। র্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার বিপুল সংখ্যক সদস্য পুরো ভবনে নিরাপত্তা ঘেরাটোপ গড়ে তোলেন। বাজেট বক্তৃতার পরে আমন্ত্রিত অতিথিরা যাতে নির্বিঘ্নে বের হতে পারেন সেজন্য সংসদ ভবনের দক্ষিণ প¬াজার পিজিয়ন হলের গেটটিও খোলা রাখা হয়েছিল। আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল আলাদাভাবে। অর্থ বিল উত্থাপন ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাজেট বক্তৃতা শেষ হলে অর্থ মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেই দাঁড়িয়ে অর্থ বিল- ২০১৯ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলী কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিলটি আগামী ৩০ জুন পাস হবে। এরআগে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্য ৪৫ ঘন্টা আলোচনা করবেন।
×