ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেম ॥ ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১৩ জুন ২০১৯

 ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেম  ॥ ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেম এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। বুধবার পুলিশ সদর দফতরে ত্রৈমাসিক অপরাধবিষয়ক সভায়ও এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়টি আলোচনায় আনেন পুলিশ কর্মকর্তারা। দুর্নীতির মামলায় দুদক পরিচালককে ঘুষ দেয়ার কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাচ্ছেন ডিআইজি মিজান। আর যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন ওসি মোয়াজ্জেম। দু-এক দিনের মধ্যেই পুলিশ সদর দফতর ডিআইজি মিজানের ঘুষ কেলেঙ্কারির বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে। ওসি মোয়াজ্জেমের গ্রেফতার বিষয়ে গোপনে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে, যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। এ জন্য সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বুধবার ত্রৈমাসিক অপরাধবিষয়ক সভায় আলোচনায় স্থান পায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়টি। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধের বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এতে পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। এ জন্য পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতর সূত্র মতে, ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন ডিআইজি মিজান। যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। কারণ ডিআইজি মিজান নিজেই ঘুষ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আইনের চোখে ঘুষ দেয়া ও ঘুষ নেয়া- দুটিই সমান অপরাধ বিষয়টি বিবেচনায় এনে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিসহ ও ফৌজদারি অপরাধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সদর দফতর। এর আগে নানা অভিযোগে তাকে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে শাস্তিমূলক সরিয়ে ওএসডি হিসেবে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন আবার দুদক পরিচালককে দেয়া ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে একজন অতিরিক্ত আইজিপির নেতৃত্বে আলাদা তদন্ত করবে সদর দফতর। দু’একদিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে। এর আগেও ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আসার পর গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে, যা আলোর মুখ দেখেনি। বুধবার পুলিশ সদর দফতরে ত্রৈমাসিক অপরাধবিষয়ক সভায়ও ডিআইজি মিজানের বিষয়টি আলোচনায় আসে বলে জানা গেছে। এদিকে ডিআইজি মিজান ও তার অডিওটি ভুয়া বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সাসপেন্ড হওয়া দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। অপরদিকে ডিআইজি মিজানুর রহমানও পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কথোপকথনের ভোকাল (কণ্ঠ) এনামুল বাছিরেরই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ডিআইজি মিজান অপরাধ ঢাকতে নিশ্চয়ই ঘুষ দিয়েছেন। তার আগের অপরাধের বিচার চলছে। নতুন করে যদি ঘুষ দেয়ার মতো অপরাধ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুদক কর্মকর্তাকে ডিআইজি মিজানের ঘুষ দেয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি ঘুষ দিয়েছেন কেন? নিশ্চয়ই তার দুর্বলতা আছে, না হলে তিনি কেন ঘুষ দেবেন? দুর্বলতা ঢাকতে তিনি ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দেয়া- নেয়া আইনে দুটোই অপরাধ। তার বিরুদ্ধে আগের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন। বুধবার বকশীবাজারের কারা অধিদফতরের কারা কনভেনশন সেন্টারে দিনব্যাপী ‘উদ্ভাবনী মেলা ও শোকেসিং ’১৯’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বুধবার কারা অধিদফতরে ‘উদ্ভাবনী মেলা ও শোকেসিং ’১৯’ শেষে পৃথক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের দেশের বাইরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি দেশেই আছেন, যে কোন সময় গ্রেফতার হবেন- আশা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মে পরোয়ানা জারি করে। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে ৬ এপ্রিল পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর দিন দশেক আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে সোনাগাজী থানায় যান নুসরাত। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন, তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ওই ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে আদালতের নির্দেশে এ ঘটনা তদন্ত করে পিবিআই। পিবিআই গত ২৭ মে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে সেদিনই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। পরোয়ানা জারির দু’দিন পর মোয়াজ্জেম হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ প্রশাসনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি অব্যাহত রাখাতেই ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেমের অপরাধের বিষয়ে আইনানুগ ব্যাবস্থা নিয়ে কাজ করছে সদর দফতর। কোন ব্যক্তির অপরাধের দায় গোটা পুলিশ প্রশাসন নেবে না। খুব শীঘ্রই এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যা অদূর ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মিজানের দুর্নীতি তদন্তে নতুন কর্মকর্তা ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নতুন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরিচালক মর্যাদার এ নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হলেন সংস্থাটির পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদ। বুধবার সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান। ঘুষ লেনদেন ও তথ্য পাচারের অভিযোগে আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর এই নিয়োগ দেয়া হলো। অপরদিকে ঘুষের কারণে নয়, কমিশনের তথ্য পাচারের অভিযোগে খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। গত ২৩ মে ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন এনামুল বাছির। আগের ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদন আমলে নেয়নি দুদক। এদিকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির বুধবার দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। যাতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুপুরে দুদক কার্যালয়ে প্রবেশের সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন খন্দকার এনামুল বাছির। সাংবাদিকদের প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সংবাদ প্রকাশে সাংবাদিকরা যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করছে না। তিনি বলেন, আমার ক্ষতি করে কুশল ও সালাম বিনিময় অপ্রয়োজনীয়। সাংবাদিকদের এড়াতে সাড়ে ১২টায় দুদকে ঢুকলাম, তবুও সাংবাদিকদের কাছ থেকে ছাড় পেলাম না। অপরদিকে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ঘুষের কারণে নয়, কমিশনের তথ্য পাচারের অভিযোগে খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সকালে দুদক কার্যালয়ে ঢোকার মুখে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘুষের বিষয় নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। তথ্য টুইস্ট করা হয়েছে। আমরা এনামুল বাছিরকে ঘুষের কারণে বরখাস্ত করিনি। এটা তো প্রমাণের বিষয়। দুদকের অভ্যন্তরীণ তথ্য বাইরে কিভাবে গেল সেটাই বড় প্রশ্ন। এতে আচরণবিধি লংঘিত হয়েছে, যদিও এটাও প্রমাণের বিষয়। উল্লেখ্য, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান চালায় দুদক। গত মাসে ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। অনুসন্ধান করেন দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছির। তার বিরুদ্ধে ডিআইজি মিজান অভিযোগ করেন, দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে এনামুল বাছিরকে দু’দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন তিনি। পরে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এদিকে ডিআইজি মিজানের ঘুষ দেয়ার ঘটনা নজরে আসায় খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানায়।
×