ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অলিগলিতে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে মধুমাসের রসালো ফল

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১৩ জুন ২০১৯

 অলিগলিতে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে  মধুমাসের  রসালো ফল

ওয়াজেদ হীরা ॥ বুধবার বেলা এগারোটা। রাজধানীর হাতিরপুল ভ্রাম্যমাণ ভ্যান থেকে ব্যাগভর্তি করে আম কিনলেন মুদি দোকানদার আমিনুল ইসলাম। ৬০ টাকা কেজি ধরে ৫ কেজি কেনায় দাম পড়েছে তিনশ’ টাকা। ব্যাগভর্তি আম নিয়ে হেঁটে যাওয়াটাও অনেকটাই মুশকিল হয়ে উঠল। পরিবারের আবদার আর মধুমাসের রসালো ফল কিনে তৃপ্তির হাসি ক্রেতার মুখে। টানা কয়েকদিন ধরেই অলিগলিতে বিভিন্ন ফলের ঘ্রাণ মিলছে। এরমধ্যে আম অন্যতম। রসালো ফলের মাস জ্যৈষ্ঠ এখন শেষের পথে। সব ধরনের ফলও এখন সবার সাধ্যের মধ্যে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত কম-বেশি সবাই প্রতিনিয়ত কিনছেন রসালো ফল। অধিক সরবরাহ আর কম দমের ফলে ভরপুর বাজার। গত কয়েকদিন ধরে নানা রাজধানীর ফলমার্কেটসহ অলিগলিতে অধিক ফল বিক্রির দৃশ্য দেখা গেছে। বিক্রেতারা বলছেন বাজার শেষের দিকে দাম কমতে শুরু করলেও ঈদের সময় খুব একটা বিক্রি হয়নি। তবে ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফেরার পর ফলের বাজার আবার জমে উঠেছে। এমনকি কিছু কিছু ফল মিলছে সবজির চেয়েও কম দামে। কয়েকদিনের ব্যবধানের রসালো ফলের সমাহার ফুরিয়ে আসবে বলে ক্রেতারাও অধিক আগ্রহ নিয়ে পরিবারের জন্য বেশি বেশি ফল কিনছেন। এদিকে জ্যৈষ্ঠ মাসের আজ ৩০তম দিন। আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, আনারসসহ দেশী রসালো ফলে টইটম্বুর বাজার। দাম কমছে, বেচাকেনাও জমে উঠেছে। ফলের বাজারের চেয়ে খোলা ভ্যানে বিক্রি আরও বেশি। এমনকি দোকানের চেয়ে অনেক ফলই কেজিতে ৫-১০ টাকা কমে পাওয়া চাচ্ছে ওসব ভ্যানে। মতিঝিলে ভ্যানে ফল বিক্রেতা সবুর উদ্দিন বলেন, আমাদের দোকানের মতো খরচ হয় না। তাই অল্প লাভেই বিক্রি করি। আমাদের লক্ষ্য থাকে প্রতিদিন কত বেশি বিক্রি করতে পারলাম। বেশি বিক্রি করতে পারলে অল্প লাভেই পুষিয়ে যায়। মতিঝিল, খিলগাঁও, শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, মুগদা, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মৌসুমি দেশী ফল বিক্রি করতে দেখা গেছে। রাজধানীর পাড়ামহল্লা, রাস্তাঘাট, ফুটপাথ থেকে শুরু করে বড় বড় সুপারশপও এখন রসালো ফলে ভরা। পাইকারি ফল ব্যবসায়ী হাকিম উদ্দিন বলেন, রোজার মাঝামাঝি ফলের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও দাম ছিল বেশি। শেষের দিকে এসে দাম অনেক কমে যায়। এখন তো পানির দামে ফল বিক্রি হচ্ছে। আরও কিছুদিন এভাবেই চলবে। পরে সরবরাহ কমতে থাকলে দাম আবার কিছুটা বাড়তে পারে। রাজধানীতে দেখা গেছে, দেশী ফলের মধ্যে বেশি মিলছে আম, লিচু। রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে বিক্রেতারা ভ্যান সাজিয়ে রেখেছেন। এছাড়া দেশী ফলের মধ্যে কাঁঠাল, কলা, জাম, আনারস, জামরুল, লটকন, গাব, বাঙ্গি, তরমুজসহ অন্য ফল তো কমবেশি পাওয়াই যাচ্ছে। শান্তিনগর বাজারের ফল ব্যবসায়ী খোকন জোয়াদ্দার জানান, জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হয়ে এলো। কিছুদিন তো ঢাকা ফাঁকাই ছিল। রবিবার থেকে ভাল বিক্রি হচ্ছে। আরেক ব্যবসায়ী জানান, লিচু বিক্রি হচ্ছে ২শ’ টাকা শ বা তার একটু বেশি। আম ৬০ টাকা কেজি দরে। এর মধ্যে ল্যাংড়া আম বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকা, হিমসাগর ৬০-১০০ এবং আম্রপালি ৭০-৮০ টাকা। আম-লিচুর দাম কমেছে দাবি করে ফল ব্যবসায়ী তমিজ উদ্দিন বলেন, গত সপ্তাহ যে লিচু তিন শ’ টাকা ছিল তা এখন বিক্রি করা হচ্ছে ২শ’। সব ধরনের আমের দামও কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা কমেছে। দাম কমায় সব শ্রেণীর মানুষের কেনারও আগ্রহ বেড়েছে। কাওরান বাজার থেকে দুই কেজি আম কেনেন হাতেম আলী। পেশায় তিনি একজন রং মিস্ত্রি। তিনি বলেন, বাচ্চারা আম খেতে খুব পছন্দ করে। কদিন আগে অনেক দাম ছিল। এখন দাম কম তাই একদিন পরপরই কিনি। আয় ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ফল কেনার দৃশ্য দেখা গেছে। কাওরানবাজারে রেললাইন ধরে রয়েছে অসংখ্য বস্তি। এসব জায়গায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস অথচ রসালো ফল খেতে সাধ্যমতো কিনছেন। আর কয়েক কদম এগিয়ে পান্থপথ বা বসুন্ধরার সামনে কিংবা হাতিরপুলের দিকে গেলেই দেখা যায় কেউ ফল কিনছেন ব্যাগভর্তি করে। মহাখালীতে ভ্যানে কাঁঠাল বিক্রি করছিলেন সাব্বির। দাম নিয়ে তিনি বলেন, ছোট কাঁঠাল ৬০-১শ’, মাঝারি ১২০-২শ’ একটু বড় হলে ২শ’ উপরে। গরমে কাঁঠাল খুব একটা খেতে চায় না জানিয়ে বলেন, আবহাওয়া প্রায় মেঘলা থাকে আর ঠা-া আবহাওয়ায় কাঁঠালের কদরও বেশি। এদিকে গত কয়েকদিন ধরে ঈদের ছুটি কাটিয়ে রাজধানীতে ফিরছে মানুষ। ফেরার পথে অনেকেই গ্রামের ফল নিয়ে আসতে দেখা গেছে। এরমধ্যে অন্যতম ছিল এই কাঁঠাল। বিশেষ করে যারা নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঈদের ছুটিতে গ্রামে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই গাড়ির পেছনে করে দু’চারটি করে কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন। এছাড়াও অন্যান্য ফলও আনতে দেখা গেছে। গাবতলীতে বাসের ছাদ থেকে ঝুড়িভর্তি আম নামাতে দেখা গেছে। প্রথমে ব্যবসায়ী মনে করলেও কথা বলে জানা গেল অফিস সহকর্মীদের বায়না মেটাতে রাজশাহী থেকে ছুটি শেষে আম এনেছেন এই বেসরকারী চাকুরে। যারা জায়গার স্বল্পতা বা অধিক ব্যাগের কারণে গ্রামের বাড়ি থেকে ফল নিয়ে আসতে পারেননি তারা দ্বিধাহীনভাবে রসালো ফলে মজেছেন টাকার বিনিময়ে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, একশ’ লিচু (বড়) ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, জাম প্রতিকেজি এক শ’ থেকে দেড় শ’ টাকা, জামরুল ৫০ থেকে ৮০, সফেদা (কেজি) ১শ’ থেকে ১৪০, লটকন ১৬০ টাকা কেজি। আনারস আকারভেদে প্রতি পিস ১৫ থেকে ৬০ টাকা, কলা ১২০ থেকে ১৫০ টাকা ডজন, চায়না বাঙ্গি ৩০ থেকে ৮০ টাকা, বড় বাঙ্গি এক শ’ থেকে ২শ’ টাকা, বেল প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কাঁচা তাল ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে তরমুজ। তবে যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম একটু চড়া। কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ২০২ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৩ লাখ ৭২ হাজার ২১৬ মেট্টিক টন আম উৎপাদিত হয়। যা আগের বছর উৎপাদন ছিল ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪৩ মে.টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে কাঁঠাল উৎপাদন ছিল ১৭ লাখ ২৭ হাজার ৬০৪ মে. টন। লিচুর উৎপাদন ছিল ২ লাখ ২৪ হাজার ২২১ মে. টন, জামের উৎপাদন ছিল ৯৯ হাজার ৬২৯ মে.টন। একই সময়ে আনারস উৎপাদন হয় ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৩ মে.টন। কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা বলছেন নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন খামারিরা। এছাড়াও দিন দিন বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে ফলের বাগান। এতে দেশে ফলের চাহিদা যেমন মিটছে তেমনি অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে এক কৃষিবিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এই নির্দিষ্ট একটা মাসে বেশি ফলের সমাহার দেখা যায়। ফল দিয়ে আরও গবেষণা দরকার কী করে বছরব্যাপী ফল পাওয়া সম্ভব।
×