ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী অঞ্চলে পাকা আমে পোকার আক্রমণ

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১৩ জুন ২০১৯

রাজশাহী অঞ্চলে পাকা আমে পোকার আক্রমণ

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ এবার ঈদের পর রাজশাহীর আমের বাজার জমে উঠায় চাষীরা খুশি হলেও বাগানের থোকায় থোকায় ঝোলা পাকা আমে পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। রাজশাহী অঞ্চলের আম বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে পরিপক্ব আম্রপালি, ফজলি ও আশ্বিনা জাতের আম। ভাল দামের আশায় অনেক চাষী বাগানে এখনও রেখেছেন হিমসাগর ও ল্যাংড়া। ঈদের ছুটি শেষে ধীরে ধীরে জমে উঠছে আমের বাজার। টানা তিন বছরের লোকসান কাটিয়ে এবার লাভের আশা দেখছেন চাষীরা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাগানে মাছি-পোকার হানায় সেই আশায় গুড়েবালি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আম চাষীরা বলছেন, মাছি-পোকার বেশি আক্রমণ হচ্ছে হিমসাগর ও ল্যাংড়ায়। গত ২৮ মে হিমসাগর এবং ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া আম নামানো শুরু হয়েছে গাছ থেকে। ফলে এই দুই জাতের আমে মাছি-পোকা দমনে কীটনাশক প্রয়োগের উপায় নেই। এলাকাভেদে এই পোকার আক্রমণ কম-বেশি। অনেকে লাভের আশা বাদ দিয়ে আম নামিয়ে বাজারে তুলছেন। কিন্তু আম্রপালি, ফজলি ও আশ্বিনা আম নামানোর সুযোগ নেই। প্রশাসনের বেধে দেয়া সময়সীমা অনুযায়ী আগামী ১৬ জুন আম্রপালি ও ফজলি এবং ১ জুলাই আশ্বিনা আম বাজারে উঠবে। হাতে সময় না থাকায় কীটনাশক প্রয়োগ নিয়েও বেকায়দায় চাষীরা। কোথাও কোথাও কীটনাশক বিক্রেতাদের পরামর্শে চাষীরা বাগানে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। নওগাঁর পোরশা উপজেলার বড়রনাইল এলাকার স্কুলশিক্ষক নাজমুল হোসাইন। ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি ও আশ্বিনা মিলে তার ৮ বিঘা আম বাগান রয়েছে। তিনি বলেন, এখন পুরো বাগানে দেখা দিয়েছে মাছি-পোকা। পোকা দমনে হিমশিম খাচ্ছি। কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে আম রক্ষার চেষ্টা করছি। এলাকার অনেক আম চাষী কীটনাশক বিক্রেতাদের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন বাগানে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। পুরো বরেন্দ্র এলাকার আম বাগানজুড়ে মাছি পোকার ব্যাপক আক্রমণ হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্যিক এই আম চাষী। এদিকে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কমিউনিটিভিত্তিক বাগান ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (রাবি)। জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমের ক্ষতিকর পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা নিয়ে গত বছর থেকে মাঠপর্যায়ে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বারির কীটতত্ত্ব বিভাগ। আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে চলমান এই গবেষণা কাজে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র। চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জগদীশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, গত বছর থেকে চাষী পর্যায়ে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা কাজ চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের বামনডাঙ্গা ও শেয়ালা এলাকায়। একই ধরনের গবেষণা কাজ চলছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার উত্তর মনিগ্রাম ও বলিহার এবং চারঘাটের হরিদাগাছি এলাকায়। বারি উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি নিয়ে তিন বছর গবেষণা শেষে তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নেয়া হবে। মূলত আকর্ষণ ও মেরে ফেলা, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ এবং সয়েল গবেষণার সমন্বয় এই প্রযুক্তি। জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক এই প্রযুক্তিতে আমের ক্ষতিকর মাছি-পোকা দমন শতভাগ কার্যকর। তবে এক্ষেত্রে কমিউনিটিভিত্তিক বালাই ব্যবস্থাপনা জরুরী। সমন্বিত এই প্রযুক্তি প্রসঙ্গে ড. জগদীশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, আম পাকার ৪০ দিনে মাছি-পোকার আক্রমণ হয়। এপ্রিলের শুরু থেকে মাঝামাঝিতে আম গাছের গোড়ায় ছত্রাক জীবাণু মিশ্রিত ট্রাইকোডার্মা সার প্রয়োগ করতে হবে। একে বলা হয় সয়েল রিসার্চ। এতে মাটিতে অবস্থানকারী মাছি-পোকা নষ্ট হয়ে যাবে। একইসঙ্গে মাছি-পোকা আকর্ষণে আম গাছের গোড়ায় এবং গাছের ডালে লঘুমাত্রায় আলফা সাইপারমেথ্রিন মিশ্রত আলাদা বিশেষ পেস্ট দিয়ে ফাঁদ দিতে হবে। মাছি-পোকা আকৃষ্ট হয়ে এখানে এলেই মারা পড়বে। তিনি বলেন, মিথাইল ইউজেনল ফেরোমন ব্যবহার করে একই সময় পাততে হবে আলাদা সেক্স ফেরোমন ফাঁদ। বোয়ামে পাতা এই ফাঁদেও প্রচুর পুরুষ পোকা মারা যাবে। এতে বাগানে মাছি পোকার আক্রমণ কমে যাবে অনেকাংশে। তবে সুফল পেতে পুরো এলাকাজুড়ে চাষীদের এই প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে। বাঘা উপজেলার উত্তর মনিগ্রাম এলাকার শহিদুল ইসলামের দেড় বিঘা বাগানে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে। শহিদুল ইসলাম জানান, দ্বিতীয় বছরের মতো এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। প্রথম বছরই আড়াই লাখ টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। এবার আম বিক্রি হয়েছে ৪ লাখ টাকার। এলাকার অনেক আম বাগান মালিক এই প্রযুক্তিতে আগ্রহী হয়েছেন। এই প্রযুক্তি প্রসঙ্গে প্রকল্পটির পরিচালক ও বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, কৃষকরা না জেনে ইচ্ছামতো আম বাগানে কীটনাশক-হরমোন প্রয়োগ করেন। এতে যেমন বাগানের ক্ষতি হয়, তেমনি আমে বিষক্রিয়া রয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। এক্ষেত্রে মুক্তি মিলতে পারে জৈব রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনায়। দিন দিন জৈব রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি জনপ্রিয় হচ্ছে। বাজারে ভাল দাম পাওয়ায় বিষমুক্ত আম উৎপাদনে ঝুঁকছেন চাষীরা। বিষমুক্ত আম রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেবে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং নাটোর জেলায় সর্বশেষ গত ২০১৭-২০১৮ কৃষি বর্ষে ৭০ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে আম বাগান ছিল। তা থেকে আম উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬১ মেট্রিক টন। এটিই এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা।
×