ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর এ্যাপল নিম্নমুখী

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১১ জুন ২০১৯

 হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর এ্যাপল নিম্নমুখী

ফিরোজ মান্না ॥ হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর বিশ্বখ্যাত এ্যাপলের বাজার ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। প্রযুক্তির বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। চীন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বদলা নেয়া শুরু করেছে। ফলে বড় বেকায়দায় পড়ছে এ্যাপল। কারণ চীনেই আইফোন এ্যাপলের বড় বাজার। শুধু তাই নয় প্রযুক্তিগত দিক থেকে এ্যাপলের নানা সমস্যা তৈরি করছে চীন। এদিকে হুয়াওয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব প্রযুক্তিবাণিজ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি সত্যিকার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন। গত শুক্রবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের এক বৈঠকে এ কথা বলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম এমন খবর দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস’র এক প্রতিবেদনে হুয়াওয়েকে দোষারোপ করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতি যদি দেশটির অন্য কোন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সমর্থন দেয় তাহলে তাদের ভয়ানক পরিণতি দেখতে হবে। চীনা এই হুঁশিয়ারিকে অনৈতিক বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন চীনা কর্মকর্তারা। হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির বদলা হিসেবে ‘অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের’ তালিকা তৈরি করেছে চীন। এ তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে ডেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চীনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড রিফর্ম কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কয়েক দফা বৈঠক করে। চীনে যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য রফতানি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এটা আসলে প্রযুক্তির সঙ্গে প্রযুক্তির যুদ্ধ। কে কার প্রযুক্তি পণ্য নিয়ে কত বড় ব্যবসা করতে পারবে তার একটি অশুভ প্রতিযোগিতা। দুই পরাশক্তি দেশ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই যুদ্ধে নতুন করে যোগ আরেক পরাশক্তি রাশিয়া। যুদ্ধটা এখন ত্রিমুখী রূপ নিয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে গুগলকে। তারা নিজেরাই বিকল্প এ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করেছে। রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে যুক্ত হয় তাহলে পরিণতি কোন দিকে যায় সেই দেখার বিষয়। এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস আমেরিকাতেই পণ্য উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন। ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার উৎপাদনের জন্য নিজের দেশেই কারখানা খুলতে চেয়েছিলেন জবস। নিজের দেশে কারখানায় উৎপাদিত এ্যাপল পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায়। ধীরে ধীরে এ্যাপলের কারখানা বড় করা হয় চীনেই। এ্যাপলের বর্তমান প্রধান টিম কুক প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুদিন পর এ্যাপলে যোগ দেন। যোগ দিয়েই কোম্পানির সাপ্লাই চেইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। এ্যাপলের পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে চীননির্ভর হয়ে ওঠে। সস্তা শ্রমের সুবিধা দিয়ে এ্যাপলকে লাভজনক করে তোলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নিষেধাজ্ঞায় সাপ্লাই চেইন এখন টেকানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে। এতে এ্যাপলের ব্যবসায় অল্পদিনেই বড় ধরনের ধস নামতে শুরু হয়েছে। যদিও এ্যাপল তাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল তা নয়। চীনের বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠী এ্যাপলের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। এ্যাপলের পণ্যের শতকরা ১৯ ভাগ বিক্রি হয় চীনে। ব্যবসা মন্দা হওয়ার পিছনেও এটি একটি বড় কারণ। চীনের বাজারে আইফোন বিক্রি কমে যাওয়ার অর্থ হলো, এ্যাপলের পুরো লাভের অঙ্ক কমে যাওয়া। মার্কিন ম্যাগাজিন ‘ওয়্যারড’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের শুরুতে চীনের স্মার্টফোনের বাজারের ১০ শতাংশ ছিল আইফোনের দখলে। এখন তা ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে চীনে তাদের পণ্য বিক্রি দিন দিন কমে আসছে। হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে চীনের জাতীয়তা বোধ আরও প্রখর হয়ে ওঠেছে। তারা এ্যাপল ফোন কেনা থেকে বিরত রয়েছে। দেশটিতে এখন হুয়াওয়ের ফোন বিক্রি বেড়ে গেছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুয়াওয়ের ওপর আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চীনে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। চীনের মানুষ আমেরিকার আনা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগকে আমলেই নিচ্ছে না। বরং মনে করছে, ক্রমেই উন্নতি করা হুয়াওয়কে ঠেকিয়ে নিজেদের বাজার বাঁচাতেই অন্যায্যভাবে হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করছে আমেরিকা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শোধ নিতে চীনের নাগরিকরা এখন হাতের কাছে পাচ্ছেন মার্কিন প্রতিষ্ঠান এ্যাপলকে। তাই চীনে বিক্রি কমে যাচ্ছে আইফোনের, আর সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাচ্ছে হুয়াওয়ে। এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ‘লাগামহীন অর্থনৈতিক অহমিকা’ দেখানোর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি ইউরোপে রাশিয়ার একটি গ্যাস পাইপলাইন ব্যর্থ করার ও বিভিন্ন দেশে হুয়াওয়ের টেলিকম যন্ত্রপাতি সরবরাহ ঠেকাতে চাপ দেয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করেন। যেসব দেশ আগে মুক্তবাণিজ্য, সৎ ও মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলত, তারা এখন বাণিজ্যযুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার মতো সুরে কথা বলছে। উল্লেখ্য, ট্রাম্প প্রশাসন গত ১৫ মে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে। সরকারী অনুমোদন ছাড়া মার্কিন সংস্থা থেকে প্রযুক্তিসেবা নেয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায় হুয়াওয়ের। এরপরই অবশ্য এই বিধিনিষেধ ৯০ দিনের জন্য শিথিল করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। মোবাইল চিপ থেকে শুরু করে সফটওয়্যার পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে হুয়াওয়ে নানা মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল।
×