ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণ ॥ আমাদের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১১ জুন ২০১৯

 বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণ ॥ আমাদের প্রত্যাশা

ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে বায়োপিক নির্মাণের কাজ গুছিয়ে এনেছেন। খুব শীঘ্রই শূটিং শুরু হবে। শ্যাম বেনেগাল ভারতের সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন The Forgotten Hero| অভিজ্ঞ চলচ্চিত্রকার শ্যাম বেনেগাল। শুধু চিত্রনাট্যের ওপর নির্ভর করে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণ বস্তুনিষ্ঠ হবে না। বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করতে হবে। জানতে হবে তাঁর জীবন দর্শন। যদিও সময় খুব অল্প। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে মুক্তি দেয়া হবে বায়োপিক। তবুও ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের চেয়ে তাঁর আদর্শের জায়গাটি অনেক বড়। ভিজ্যুয়াল ইমেজ নির্মাণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ম্যাটাফরিক ইমেজ নির্মাণ। চলচ্চিত্রের ফরম, আঙ্গিক, টোন, কালার, ডিটেইল এবং আলোক সম্পাত প্রাঞ্জল হতে হবে। চিত্র ধারণের ব্যাকরণ আর এ্যাসথেটিকস শুধু নয় বস্তুনিষ্ঠ কাহিনী রচনার অঙ্গীকার থাকা জরুরী। জাতির জনকের বিভিন্ন ফুটেজ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে নির্মাণশৈলী ও নান্দনিকতার ছাপ প্রশংসনীয় হবে। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বাঙালীর মণিকোঠায় স্থান পাননি। তিনি ছিলেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা, আপন সত্তার মতো। রাজনৈতিক দার্শনিক। নীতি ও আদর্শের পথিকৃৎ। তাঁর জন্মের পূর্বে এবং পরে যারা এই উপমহাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে ইতিহাসে সমাদৃত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন ও ভাবনার জায়গায় পার্থক্য ছিল। বাঙালীর টেম্পারমেন্ট মনে ও হৃদয়ে ধারণ করে রাজনীতি করতেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্য তাঁকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বলা হয়। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসও তাই অনুসরণ করতে হবে। বায়োপিকে মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র (যিনি লিখেছিলেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে...’ কবি আব্দুল হাকিম তাঁর কবিতায় বাঙালী হতে আহ্বান করেছিলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ প্রেম আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের তেজোদীপ্ত কাব্য বঙ্গবন্ধুকে সাহসী ও মানবিক করে তুলেছিল। জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দাশ (যিনি লিখেছিলেন ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে... কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।) ও জীবনানন্দ দাশকে বঙ্গবন্ধু ভালবাসতেন। তাঁর দর্শন ও রাজনীতিতে এদের প্রভাব রয়েছে। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু যাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়ে ছিলেন তাদের চেয়ে অনেক উঁচুমাত্রার দর্শন তিনি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেমন মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) দীর্ঘ সময় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে তার রজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী যত আন্দোলন (‘চম্পারন আন্দোলন’ (১৯১৭) থেকে ‘আইন অমান্য ও ভারত ছাড় আন্দোলন’ (১৯৪২)) তিনি করেছিলেন, তার মধ্যে দু-একটি ছাড়া কোন আন্দোলনই সফলভাবে যবনিকা পায়নি। বার বার রাজনৈতিক কৌশল, নির্দেশনা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি ব্রিটিশরাও কংগ্রেসের (১৮৮৫) রাজনীতিকে ‘আবেদন, নিবেদন, প্রতিবেদন’ কাঠামোভিত্তিক রাজনৈতিক দল মনে করতেন। অরবিন্দ ঘোষ, বিনায়ক দামোদার সাভারকার প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশদের জেল-জুলুম সহ্য করতে না পেরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ধর্মকর্ম নিয়ে। গান্ধীজী নিজেও থাকতেন আশ্রমে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) বলেছিলেন ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’, কিন্তু প্রচার করেছেন ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র হবে। হয়েছিলও তাই। রাজনৈতিক জীবনে ধর্ম-কর্ম করেছেন, এমনটা তার আত্মজীবনীতে নেই। কিন্তু টুপি পরতেন সব সময়। তার পরিহিত টুপির খ্যাতি ছিল ‘জিন্নাহ টুপি’ হিসেবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ (১৯০৬) রাজনৈতিক দলটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিম উদ্দিন প্রমুখ রাজনীতিবিদদের পকেটের দলে পরিণত হয়েছিল। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল দুই পাকিস্তানেই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার মানুষের একজন। যতটা রজনীতিবিদ তার চেয়ে বেশি বাঙালী। শেরে-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু বাঙালীর মুক্তির জন্য তেমন ত্যাগ স্বীকার করেননি। ফজলুল হক সাহেব প্রথমে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে রাজনৈতিক দল করেছিলেন, পরে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ নামে। দুটো রাজনৈতিক দলের কোনটিই জনগণের জন্য তেমন কিছু করেননি। তিনি ইংরেজীতে কথা বলতেন, উর্দুতেও ছিলেন সমঝদার। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বাংলা ভাষা ব্যবহার করতেন কদাচিৎ। ইংরেজি সাহেবদের মতোই চালচলন ছিল। রাজনীতি করতেন কলকাতা ও পাঞ্জাবে। মওলানা ভাসানী বাংলা ভাষা বলতেন কৃষকদের মুক্তির জন্য। রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তি ধর্ম হলেও কৃষকশ্রেণীর দাবি-দাওয়া নিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তাঁর দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল ন্যাপ (১৯৫৭) মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি কখনও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ও রাজনীতির ঠিকানা কখনও পরিবর্তন হয়নি। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯)-এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক পদ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ সময় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং শাহাদাত বরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার নিসর্গ প্রকৃতির সন্তান শেখ মুজিব, মাটি আর মানুষের জন্য যিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তিনিই আজ বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির পিতা হতে পেরেছেন। সে কারণে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক যেন এদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ধানম-ির ৩২ নম্বর, যা বাঙালীর ঠিকানা, তার প্রতিটি কামরা, বারান্দা, সিঁড়ি বায়োপিকে থাকবে তো? বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পশের্র প্রিয় পাইপ, ৭ মার্চের তর্জনী, ১৫ আগস্টের সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি যা পরতে চেয়েছিলেন খুনীদের কাছে, রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতার ভালবাসার সঙ্গী রেনু (বেগম মুজিব), শুধু ইমেজে নয় আবেগ, প্রপস, নান্দনিক ডিটেইলে চিত্রিত হতে হবে। প্রিয় রাসেলের মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি, ছোট ভাই শেখ নাসের কিংবা ব্যক্তিগত সহকারী কর্নেল জামিল কি বাদ যাবেন চিত্রনাট্য থেকে? কিংবা পাকিস্তানের কারাগার, যার পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য, তা কিভাবে সেলুলয়েডে ধারণ হবে? ৬ দফার লাহোর, ৭ জুন মনু মিয়ার বেভারেজ কোম্পানি, ত্রিপুরার আগরতলা আর আমাদের উত্তাল ঊনসত্তর বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু কিভাবে থাকবেন বায়োপিকে? ১৯৭০ সালের নির্বাচন, সারা পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নির্বাচনের অগ্নিঝরা বক্তৃতা, ব্যাপক বিজয় নিয়ে পাকিস্তানের হবু প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গভূমিতে একাত্তরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ‘গণহত্যা’ এবং ২৬ মার্চের প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, বায়োপিকের উপজীব্য হবে- এটা প্রত্যাশা করি। পর্দায় বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক দেখে মানুষ যেন বলতে পারে, ৫৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের পরতে পরতে খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে শেখ সাহেব, শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার সবটুকু চিত্রনাট্যে থাকলে যে একটি সফল বায়োপিক হবে তাতে সন্দেহ নেই। চিত্রনাট্যকার অতুল তিউয়ারি ও পরিচালক শ্যাম বেনেগালের প্রতি শুভ কামনা থাকল। লেখক : চেয়ারম্যান, সমাজকর্ম বিভাগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
×