ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ড

দুর্নীতিতে জড়িত সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ১১ জুন ২০১৯

 দুর্নীতিতে জড়িত সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

মশিউর রহমান খান ॥ বনানীতে এফআর (ফারুক-রূপায়ণ) টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী নক্সা অনুমোদন ও নির্মাণ কাজে জড়িত দায়ী ৬২ কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই তালিকায় রাজউক কর্মকর্তা কর্মচারীর মধ্যে ভবন পরিদর্শক, নক্সাকার থেকে শুরু করে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম, রাজউক সদস্য (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা) ডি এম বেপারিও রয়েছেন। এছাড়া দায়ী কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী ইতোমধ্যেই অবসর নিয়েছেন, কয়েকজন অন্য সংস্থায় বদলি হয়ে গেছেন। এমনকি দায়ীদের কেউ কেউ মারা গেছেন। নির্দেশ বাস্তবায়ন করা গেলে এর মাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এত অধিক সংখ্যক দায়ী সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির সৃষ্টি হবে। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অতিদ্রুতই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের কাছে কারণ দর্শানোর চিঠি দেবে রাজউক। এরপর শুরু হবে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৩১ নিহত ও অর্ধশতাধিক আহন হন। এরপর ভবনটির নক্সা অনুমোদন ও নির্মাণ সংক্রান্ত কাজে কোন ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করতে রাজউক ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি পৃথক পৃথক রিপোর্ট প্রদান করে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য রাজউককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি। এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর রিপোর্ট মতে দায়ী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গণপূর্তমন্ত্রীর এ নির্দেশ কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় দেশবাসী তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। রাজউক সূত্র মতে, তালিকায় থাকা কোন কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা বা বেতন ভাতা স্থগিত থেকে শুরু করে পদোন্নতি বা পদাবনতি প্রদান বা কোন কোন কর্মকর্তা কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হতে পারে। গণপূর্তমন্ত্রী দায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অতিদ্রুতই শাস্তিমূলক আইনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাজউককে নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, নিয়মানুযায়ী প্রথমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পৃথক ফাইন তৈরি করে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না তার জন্য কারণ দর্শানো নোটিস প্রদান করবে রাজউক কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে অন্য যেসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন তাদের দায় নিরুপণ করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি প্রদান করবে। জানা গেছে, অভিযুক্তদের মধ্যে জড়িত কেউ কেই গণপূর্ত মন্ত্রণালয়েরই অন্য বিভাগে চাকরিরত রয়েছে তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেবে রাজউক। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি ও অপরাধ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে গত ২২ মে রাজধানীর বনানীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পতিত এফআর (ফারুক-রূপায়ণ) টাওয়ারের নক্সা অনুমোদন ও নির্মাণ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে সরকার। রিপোর্টে ভবনটি ২৩ তলা পর্যন্ত নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রাজউক সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম থেকে শুরু করে সদস্য ডি এম বেপারিসহ সংস্থাটির পরিদর্শক, সংশ্লিষ্টসহ মোট ৬২ জনকে চিহ্নিত করে গঠিত তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে আবাসন প্রতিষ্ঠানকেও দায়ী করেছে কমিটি। অপরদিকে রিপোর্টে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড রাজউকে দাখিলকৃত এ ভবনের ২৩ তলার নক্সাটি অবৈধ ছিল যার কোন ভিত্তি খুঁজে পায়নি বলে কমিটি। একই সঙ্গে নক্সাটি সংঘবদ্ধ চক্রের জালিয়াতি করে সৃজন করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এছাড়া ১৮ তলা পর্যন্ত ভবনটির অনুমোদন বৈধ থাকলেও উপরের ৫ তলা ভবনটি সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই এটি ভাঙ্গার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ও ভবনটি নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে চিহ্নিত সব স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী ও আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তদন্ত প্রতিবেদনে ৭ দফা পর্যালোচনা ও ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করে কমিটি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইয়াকুব আলী পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে গঠিত ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনার ৫৫ দিন পর এই রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টে জানমালের ক্ষয় ক্ষতির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়ী বলে শনাক্ত করা হয়। রিপোর্টে ভবনের অতিরিক্ত অংশ ভেঙ্গে ফেলতে বলা হয়। আর সেটা সম্ভব না হলে সিলগালা করে দেয়ার সুপারিশ করে। ভবনটি নির্মাণকালের রাজউক চেয়ারম্যান, অথরাইজড অফিসার ও সহকারী অথরাইজড অফিসারের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের ও কর্মরতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়। অগ্নিকান্ডের পেছনে ভবন মালিক পক্ষের প্রচলিত ব্যবস্থা ও নিয়ম নীতির প্রতি চরম অবহেলা দেখতে পায় তদন্ত কমিটি। তদন্ত রিপোর্টে ভবনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট ও বরাদ্দ গ্রহীতা এফআর টাওয়ার প্রোপার্টিজ’র সৈয়দ মোঃ হোসাইন ইমাম ফারুকসহ এফআর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটিকেও এই অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, ২৩ তলা বিশিষ্ট এফআর টাওয়ারের নক্সাটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। আর এর দায় তৎকালীয় রাজউক চেয়ারম্যান কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। সে সময়ের রাজউক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, অথরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহম্মেদ, অথরাইজড অফিসার নাজমুল হুদা, সহকারী অথরাইজড অফিসার মোঃ বদরুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা দায়ের করার সুপারিশ রয়েছে এই প্রতিবেদনে। রিপোর্টে ভবনটি নির্মাণের সময়ে (ফেব্রুয়ারি ২০০৫ থেকে জুলাই ২০০৮ পর্যন্ত) রাজউকের যারা তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে ২০ জনকে দায়ী করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান ইমারত পরিদর্শক মাহবুব হোসেন সরকার ও মোঃ আবদুল গণি ও ১৮ জন ইমারত পরিদর্শক রয়েছেন। এছাড়া ভবনের ২০, ২১ ও ২২ তলার বন্ধক অনুমতি দিয়েছেন এমন ৬ কর্মকর্তা কর্মচারীকে দায়ী করা হয়। এছাড়া রাজউকের সাবেক সদস্য জি এম বেপারি, সবেক নগর পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সাইদুর রহমান, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ, লিজ গ্রহীতা মোঃ হোসাইন ইমামকেও এ অগ্নিকা-ের জন্য দায়ী করা হয়। ভবনের ২৩ তলা বিশিষ্ট নক্সাটি বৈধতা দেয়ার জন্য বিভিন্ন রেজিস্ট্রারে অবৈধ এন্ট্রি ও ইস্যু দেখিয়ে যারা এই অপরাধে সহযোগিতা করেছেন এমন ২৪ কর্মকর্তা কর্মচারীকেও দায়ী করা হয়। মনিটরিংয়ে ব্যত্যয়ের জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ইয়ামিনসহ ৯ জন। রিপোর্টে বলা হয়, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জরুরী বহির্গমণ নক্সা অনুযায়ী হয়নি। ভবন তৈরিতে দায়িত্বশীলতা, মনযোগিতা ও দক্ষতা তিনটিরই অভাব ছিল। আর সর্বোপরি এতে অবহেলার ভাবটি প্রকট ছিল। আগুনের ঘটনা ওই অবহেলার বিষয়টিই প্রমাণ করে। এ বিয়য়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনের পর রাজউক ও মন্ত্রণালয়ে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার রিপোর্ট আমরা ইতোমধ্যেই জনসমক্ষে প্রকাশ করেছি। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী নক্সা অনুমোদন ও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট অবৈধ কাজে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে অথরাইজড অফিসার, ইন্সপেক্টর পর্যন্ত জড়িত ৬২ কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অতিদ্রুতই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজউক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করেছি। চাকরি বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতিদ্রুতই এ নির্দেশ কার্যকর হবে। পদবি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেয়া হবে। এছাড়া গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থদের বিরুদ্ধে রাজউক ও মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। অন্যায়কারী কাউকেই কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। আমরা চাই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবন নির্মাণে জড়িত অন্যায়কারীরা সতর্ক হোক এই ভেবে যে, অন্যায় করে কেউ পার পেতে পারে না।
×