ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্য নির্ধারণ কমিটির দরও মানছে না কারখানা মালিকরা;###; উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ২০ টাকা, বিক্রি ১৫ টাকা;###; ওজনে ৪০ ভাগ পাতা কর্তন

পঞ্চগড়ে কাঁচা চা পাতার দরপতন!

প্রকাশিত: ১০:৩১, ১১ জুন ২০১৯

 পঞ্চগড়ে কাঁচা চা পাতার দরপতন!

এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড় ॥ আবারও চা পাতার দাম কমেছে। সরকার নির্ধারিত দর মানছেন না কারখানা মালিকরা। সিন্ডিকেট করে কাঁচা চা পাতার দর কমিয়ে দেয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষী। কারখানা মালিকরা অধিক মুনাফা অর্জন করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেলেও এসব দেখার কেউ নেই। সিন্ডিকেট করে চা পাতা কেনার ফলে গত একমাসে কাঁচা চা পাতার দাম কমেছে কেজিপ্রতি ২০ টাকা। পঞ্চগড় চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ২৪ টাকা করে দেয়ার পরও কারখানা মালিকরা তা না মেনে লো ভোল্টেজ ও যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে প্রতিদিন কোন না কোন কারখানা বন্ধ রাখছেন। যে কারণে চা পাতা তোলার পর কারখানায় সরবরাহ করতে পারছেন না চাষীরা। চাষীদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে, যাতে চাষীরা সময়মতো চা পাতা সরবরাহ করতে না পারে। বাগান থেকে চা পাতা উত্তোলনের পর কারখানায় সরবরাহ পর্যন্ত নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন চাষী। অথচ গত এপ্রিলেই কারখানা মালিকরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে চাষীর কাছ থেকে পাতা ক্রয় করেছিল। মৌসুম শুরু হতেই কারখানা মালিকদের শুরু হয় টালবাহানা। সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়াই ২ মে থেকে ১৩টি কারখানা ১৫ টাকা দরে চা পাতা কিনতে শুরু করে। এতে বিপাকে পড়ে ক্ষুদ্র চা চাষী। চা পাতার ন্যায্যমূল্যের দাবিতে চাষীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করে। সড়ক অবরোধ ছাড়াও জেলা প্রশাসক অফিস ঘেরাও করে স্মারকলিপিও দেয় তারা। এ নিয়ে গত ১৫ মে জেলার ক্ষুদ্র চা চাষী, চা কারখানা মালিক ও টি বোর্ডের প্রতিনিধি নিয়ে চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক এক সভার আয়োজন করে। সভায় টি বোর্ডের ফর্মুলা অনুযায়ী বিগত বছরের ৪৫টি অকশনের মূল্য গড় হিসাব করে প্রতিকেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য আসে ২৫.৭৫ টাকা। কারখানা মালিকরা এতে আপত্তি জানালে উভয়পক্ষের আলোচনায় ২৪ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন সভায় সভাপতিত্ব করেন। পরবর্তীতে কারখানা মালিকরা ওই সিদ্ধান্তকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের মনগড়া মূল্যে চা পাতা ক্রয় করা শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তারা প্রতিকেজি কাঁচা চা পাতার ওজনে ২৫% থেকে ৪০% পাতা কর্তনও করে নিচ্ছেন। গত ২৯ মে আবারও পঞ্চগড় চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি চা চাষী ও কারখানা মালিকদের নিয়ে জরুরী সভা আহ্বান করে। সভায় মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতিকেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করে ২০ টাকা। কিন্তু চা চাষী ও কারখানা মালিক কোন পক্ষই এই দর মেনে নেয়নি। ফলে কারখানা মালিকরা তাদের মতো মনগড়া দরে চা পাতা কিনছেন। এতে চাষীরা ব্যাপক লোকসান গুনছেন। চাষীদের অভিযোগÑ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিকেজি চা পাতা উৎপাদন করতে তাদের খরচ পড়ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। সেই চা কারখানায় নিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ টাকায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে চা চাষীরা যেমন পথে বসবেন তেমনি হুমকিতে পড়বে পঞ্চগড়ের সমতলের এই চা শিল্প, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলা প্রশাসক অফিসে অনুষ্ঠিত ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন জানান, চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রতিকেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য ২৫.৭৫ টাকা নির্ধারণ করলে কারখানা মালিকরা তাতে আপত্তি জানায়। আলোচনাসাপেক্ষে ২৪ টাকা প্রতিকেজি কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করার পাশাপাশি বৃষ্টি হলে প্রতি ১শ’ কেজিতে সর্বোচ্চ ১০% কর্তন করারও সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, ওইদিন কারখানা মালিকরা সভার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও জেলা প্রশাসক অফিস থেকে বের হয়ে তাদের মত বদলে ১৫ টাকা কেজি দরে চা পাতা ক্রয়ের ঘোষণা দেয়। পঞ্চগড় শহরের মসজিদপাড়ার চা চাষী আতাউর রহমান জানান, চা পাতা উত্তোলনের এই ভরা মৌসুমেই মূল্য বিপর্যয়ের কারণে চাষীর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কারখানা মালিকরা সরকার নির্ধারিত দরও মানছেন না। তারা তাদের খেয়াল-খুশিমতো দর দিয়ে চা পাতা ক্রয় করছেন। মূল্য নিয়ে উচ্চবাচ্চ করলে ওই চাষীর চা পাতাই কিনছেন না। লোকসান হলেও কম দামে চা পাতা বিক্রি করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাটের চাষী জসিয়ার রহমান প্রধান কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট ও খামখেয়ালিপনাকে দায়ী করে বলেন, আমরা চা চাষীরা কারখানা মালিকদের হাতের পুতুল। কারখানা মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই আমাদের চলতে হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ন্যায্যমূল্য না পেলে আগামীতে চাষীরা চা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনাময় চা শিল্পটিও ধ্বংস হবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। তেঁতুলিয়ার আজিজনগরের ক্ষুদ্র চা চাষী শওকত আলী বলেন, চা পাতা উৎপাদনের শুরুতে কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দিয়েছে। এতে বড় বাগান মালিকদের তেমন ক্ষতি না হলেও ক্ষুদ্র চাষীর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। শালবাহানের চাষী বশির আলম জানান, কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দিয়েছে। তারা নির্ধারিত মূল্যও মানছেন না। প্রতিকেজি চা উৎপাদন করতে যেখানে ১৫ থেকে ১৮ টাকা খরচ পড়ে যায় সেখানে ১৫ টাকা দরে চা বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের চা গাছ কেটে ফেলতে হবে। পঞ্চগড় জেলা স্মল টি গ্রোয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামাল উদ্দিন বলেন, চায়ের ভরা মৌসুমে কারখানা মালিকরা কৌশল করে কাঁচা চা পাতার দাম কমিয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, অকশন মার্কেটে চা পাতার দাম কমেছে তাই তারা দাম কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মূলত তারা অকশন মার্কেটে নিম্নমানের চা নিয়ে যাচ্ছে। তাই দাম কম পাচ্ছে। আর সেই দায়ভার চাষীর ঘারে চাপানোর চেষ্টা করছে বলে তিনি জানান। চা চাষীদের দীর্ঘদিনের প্রধান যে দুটি দাবি ছিল। তা হলো- পঞ্চগড়ে সরকারীভাবে একটি চা কারখানা স্থাপন এবং অপরটি হলো টি বোর্ড কর্তৃক বিক্রয় সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাষীর কাছ থেকে চা পাতা ক্রয়ের মাধ্যমে কারখানাগুলোয় সরবরাহের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ দুটি দাবির কোনটিই আজ অবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই দ্রুত এই দাবি দুটি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পঞ্চগড়ের চা চাষীরা। চা চাষের ইতিবৃত্ত ॥ বাংলাদেশ চা বোর্ড চলতি মৌসুমে কোটি কেজি তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদনের আশা করছে। মার্চ থেকে নবেম্বর পর্যন্ত চায়ের এই ভরা মৌসুমে বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের’ আওতায় পঞ্চগড় এবং পাশর্^বর্তী ঠাকুরগাঁও জেলায় চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৫ লাখ কেজি। কিন্তু যে হারে চায়ের চাষ হয়েছে তাতে এক কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলে চা চাষ সম্প্রসারণ এবং চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি হাতে নেয়ার পরই চা চাষে বিপ্লব সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক নির্দেশনায় বিগত ২০০০ সালের এপ্রিলে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম স্থানীয় চাষী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের পঞ্চগড়ে চা আবাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা পঞ্চগড়ে ছুটে এসে মাঝারি ও বড় আকারে চা বাগান করার পাশাপাশি গ্রামের চাষীরাও ছোট ছোট আকারে চা বাগান করেন । শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে চা আবাদ। এর পর চা আবাদের পরিধি বাড়তে থাকে। বেড়ে যায় চায়ের উৎপাদন। ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের’ আওতায় এখন পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে চা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় মোট চা আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৭৯২ একর জমিতে। যার মধ্যে নিবন্ধিত চা বাগান (স্টেট পর্যায়ে-২৫ একরের ওপর) রয়েছে ৭টি এবং অনিবন্ধিত ১৮টি। ক্ষুদ্রায়তন বাগান (স্মল হোল্ডার-৫ থেকে ২৫ একর) নিবন্ধিত রয়েছে ১৫টি এবং অনিবন্ধিত ২টি। এছাড়া ক্ষুদ্র চা চাষীর সংখ্যা (শূন্য থেকে ৫ একর) নিবন্ধিত ৬১৮ জন এবং অনিবন্ধিত ৩ হাজার ১৯০ জন। চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা ॥ পঞ্চগড় জেলায় ১২টি এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় ১টিসহ মোট ১৩টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এসব কারখানায় পঞ্চগড়ে উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা থেকে মেড টি উৎপাদন করা হয়। কারখানাগুলো চা চাষীর কাছ থেকে সবুজ চা পাতা সংগ্রহ করে। এই ১৩ টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতার প্রয়োজন হয়। তবে, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য না দেয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত চায়ের অকশন মার্কেট চট্টগ্রামে হওয়ায় সেখানে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এক নজরে পঞ্চগড়ের চা উৎপাদন- চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের সূত্র মতে, জেলায় ২০১৪ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ৬৩ লাখ ২৭ হাজার ৪২৭ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৪৬৭ কেজি। ২০১৫ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬২ হাজার ২৬ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ২১ হাজার ৯২১ কেজি। ২০১৬ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৯৩ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ ৬ হাজার কেজি। ২০১৭ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮১ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি।
×