ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের কাছে হার অস্ট্রেলিয়ার

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ১০ জুন ২০১৯

ভারতের কাছে  হার অস্ট্রেলিয়ার

মিথুন আশরাফ ॥ উইকেট ব্যাটিং স্বর্গ হলে যে ভারত কতটা ভয়ঙ্কর, তা বোঝা গেল। ওপেনার শিখর ধাওয়ানের সেঞ্চুরির (১১৭) পর বিরাট কোহলির (৮২) দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপে রেকর্ড রান করল ভারত। তাতে করে ৩৬ রানে জয় তুলে নিল ভারত। দুই দলের ম্যাচের দিকেই সবার দৃষ্টি ছিল। সমান শক্তির দুই দল, উত্তেজনা মিলবে, এমন ধারণাই ছিল। সেই উত্তেজনা অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের মাঝপথে খানিক ছড়ালও। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারতই জিতল। মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করার পর মাঝখানে দুই ম্যাচ বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। আবার যখন বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া সামনে পড়ল, ধাওয়ান সেঞ্চুরি করে দেখালেন। ১০৯ বলে ১৬ চারে ১১৭ রান করলেন। তার এই সেঞ্চুরির সঙ্গে বিরাট কোহলির ৮২, রোহিত শর্মার ৫৭ ও হার্দিক পান্ডিয়ার ৪৮ রানে অস্ট্রেলিয়ার সামনে বড় টার্গেটই দিল ভারত। লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট মাঠে ৫ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩৫২ রান করল ভারত। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে ৩০০ রানের উপরে স্কোর করল ভারত। এরআগে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৮৯ রান যে করেছিল ভারত, সেটি রবিবারের আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান ছিল। এবার সেই রানকেও টপকে গেল কোহলির দল। ৩৫৩ রানের বিশাল টার্গেটে খেলতে নেমে ৩১৬ রান করতে পারল অসিরা। ৫০ ওভারে অলআউটও হলো অস্ট্রেলিয়া। এই রান হলো স্টিভেন স্মিথের ৬৯, ওয়ার্নারের ধীরগতির ৫৬ রানের ব্যাটিং এবং এ্যালেক্স ক্যারির অপরাজিত ৫৫ রানের ইনিংসে। জাসপ্রিত বুমরা ৩টি, ভুবনেশ্বর কুমার ৩টি ও যুজবেন্দ্র চাহাল ২ উইকেট করে শিকার করলেন। এরআগে কখনই বিশ্বকাপে ৩০০ রানের টার্গেটে খেলতে নামতে হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে। কোন দল যে এমন টার্গেট দিতেই পারেনি। ৩৫০ রানের বেশি টার্গেটতো অনেক! ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে ২৮৭ রানের টার্গেটে খেলতে হয়েছে, সেটি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ টার্গেট ছিল। এবার রানের পাহাড়ের সামনে পড়ল অসিরা। এই রান অতিক্রম করতে গিয়ে শুরুটা যেমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন দ্রুতগতিতে হয়নি। ১০ ওভারে ৪৮ রানের বেশি করতে পারেনি অসিরা। দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও এ্যারন ফিঞ্চ মিলে ধীরনীতি অবলম্বন করেন। কোনভাবেই ভারত বোলারদের আউট করার সুযোগ দেননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য! দলের ৬১ রান হতেই দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে যাদবের দুর্দান্ত থ্রোতে এ্যারন ফিঞ্চ (৩৬) রান আউট হয়ে যান। ফিঞ্চ আউট হওয়াতে গতি আরও কমে যায়। ২০ ওভারে গিয়ে ৯৯ রান করে অস্ট্রেলিয়া। ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহ, হার্দিক পান্ডিয়া, কুলদীপ যাদব, চাহালরা চাপে রাখেন ওয়ার্নার ও স্টিভেন স্মিথকে। ওয়ার্নার রানের চেয়ে বল বেশি খেলতে থাকেন। চাপ তৈরি হতে থাকে। একটা সময়ে গিয়ে ওয়ার্নার হাফসেঞ্চুরিও করেন। কিন্তু ৮৪ বলে ৫৬ রান করতেই চাহালের ঘূর্ণির ফাঁদে পড়েন ওয়ার্নার। তার আউটে যেন অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সব আশাও শেষ হয়ে যায়। স্মিথের সঙ্গে ৭২ রানের জুটি গড়ে দলের ১৩৩ রানের সময় ওয়ার্নার আউট হলে অসিদের জিততে হাতে থাকে ২৫ ওভার, ৮ উইকেট। রান তখনও লাগে ২২০। ওভারে ৮ রানের উপরে লাগে। কতটা কঠিন। তা সবাই বুঝে যায়। স্মিথ ও উসমান খাজা মিলে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকেন। ৩৬ ওভারে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ২০০ রান করে। আর যখন ২ রান যোগ হয়, ঠিক তখন খাজাকে (৪২) আউট করে দেন বুমরাহ। ব্রেক থ্রু এনে দেন। কিন্তু এই সময় থেকে যেন অন্য অস্ট্রেলিয়াকে দেখার মিলে। স্মিথ আগে থেকেই উইকেটে থাকেন। যোগ হন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। দুইজনই ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন। রানের গতি হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেন। তাতে ভারতের হতাশাও যেন যুক্ত হতে থাকে। ভুবনেশ্বর নিজের সপ্তম ওভার করতে এসে সব পাল্টে দেন। এলবিডব্লিউয়ের রিভিউ নিয়ে স্মিথকে (৬৯) আউট করার পর মারকাস স্টোইনিসকেও বোল্ড করে দেন। এক ওভারে ২ উইকেট নিয়েই ভুবনেশ্বর খেলা ভারতের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। দলের ২৪৪ রান হতেই ম্যাক্সওয়েলকেও (২৮) যখন চাহাল আউট করে দেন, ম্যাচ থেকে পুরোই ছিটকে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। শেষে এ্যালেক্স ক্যারি (৩৫ বলে অপরাজিত ৫৫) চেষ্টা করেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ৩১৬ রানের বেশি করতে পারেনি। এই ম্যাচ খেলতে নামার আগে মার্চে ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে তৃতীয় ওয়ানডে জেতার পর টানা ১০ ম্যাচ জিতে অসিরা। শেষপর্যন্ত ভারতের কাছে এসে সেই জয়ের ভিত নড়ে গেল। ভারত বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচ জিতল। দক্ষিণ আফ্রিকার পর অস্ট্রেলিয়াকেও হারাল ভারত। অস্ট্রেলিয়া দুই ম্যাচ জিতে তৃতীয় ম্যাচে হারল। ম্যাচের আগে একটি আলোচনাই সবখানে ছিল। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণ শক্তিশালী। পেট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, নাথান কোর্টার নেইল, এ্যাডাম জাম্পাদের বোলিংয়ের সামনে কী ভারত ব্যাটসম্যান ধাওয়ান, রোহিত, কোহলিরা টিকতে পারবেন? টস জিতে যখন ব্যাটিং নিল দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত আর অধিনায়ক বিরাট কোহলি বলে দিলেন, ‘আগে ব্যাটিংই করতে চাই। স্কোরবোর্ডে বড় রান জমা করে অস্ট্রেলিয়াকে চাপ দিতে চাই।’ কোহলির কথায় মনে হয়েছিল, কত সহজ! কিন্তু যখন ব্যাটিং করলেন ভারত ব্যাটসম্যানরা, মনে হলো আসলেই তাই; সহজ। সেই সহজ কাজটি আরও সহজ হয়ে গেল, যখন অসি পেসার আর স্পিনাররা কিছুই করতে পারলেন না। সঙ্গে ক্যাচ মিস হল। যার সুবিধা নিয়ে ২ রানেই ‘নতুন জীবন’ পাওয়া রোহিত ৫৭ রানের ইনিংস খেললেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্রুত ২০০০ রান করার কৃতিত্ব দেখালেন। তিনি যখন আউট হলেন, ততক্ষণে ভারত ২৩ ওভারেই ১২৭ রানে চলে গেল। দুই ওপেনার রোহিত ও ধাওয়ান মিলেই বুঝিয়ে দিলেন, ভারত বড় সংগ্রহই গড়তে চলেছে। ভারতের স্কোরবোর্ডে ১০০ রান হওয়ার আগেই ধাওয়ানও হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। দুইজন মিলে দলকে ১০০ রানে নিয়ে যান। যখন ১২৭ রান হয়, তখন প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করা রোহিত আউট হওয়ার পর রানের গতি কিছুটা কমে। ৩০ ওভারে গিয়ে ১৭০ রান করে ভারত। ধাওয়ানকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন কোহলি। একদিকে ধাওয়ান রান তুলতে থাকেন। আরেকদিকে কোহলি বুঝে এগিয়ে যেতে থাকেন। ৯৬ বলে শেষপর্যন্ত সেঞ্চুরিও করেন ধাওয়ান। ক্যারিয়ারের ১৭তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ সেঞ্চুরি করেন। এবার বিশ্বকাপে প্রথম এবং দুটি বিশ্বকাপে তৃতীয় সেঞ্চুরি করেন। তবে এই সেঞ্চুরি ধাওয়ানকে উঁচুতে আসীন করেছে। আইসিসির টুর্নামেন্ট হিসেবে নিলে ধাওয়ান ৬টি সেঞ্চুরি করলেন। ভারতের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আইসিসি টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি করার দিক দিয়ে ৭ সেঞ্চুরি করে করা ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী ও শচিন টেন্ডুলকারের পরেই আছেন ধাওয়ান। তার এই সেঞ্চুরিতে ভারতও খুব ভালভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে। তবে ধাওয়ান সেঞ্চুরির পর খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। সেঞ্চুরি করার পর আর ১৭ রান যোগ করতেই আউট হয়ে যান। তবে সাজঘরে ফেরার সময় যেন স্বস্তি নিয়ে যান। তার ফর্ম নিয়ে যে তুমুল আলোচনা হচ্ছিল। বিশ্ব মঞ্চেই সেঞ্চুরি করে জবাব দিলেন ধাওয়ান। আউটের আগে অবশ্য কোহলির সঙ্গে ৯৩ রানের জুটি গড়েন। রোহিত ও কোহলির সঙ্গে দুটি বড় জুটি গড়ে দলকে ২২০ রানে রেখে আউট হন ধাওয়ান। তখন ৩৭ ওভার হয়। হাতে থাকে আরও ১৩ ওভার। এই ওভারগুলোতে এখন কোহলি, পান্ডিয়া, রাহুল, ধোনিদের যা করার করতে হবে। রোহিত, ধাওয়ানের পথ অবলম্বন করতে পারলে সাড়ে তিনশ হওয়া খুবই সম্ভব। আর না পারলে ধস নামবে। তখন বিপদে পড়বে ভারত। এমন যখন ভাবনা হচ্ছে, তখন কোহলি আর পান্ডিয়া মিলে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করতে থাকেন। দ্রুত স্কোরবোর্ডে রান জমা করতে থাকেন। রাহুল কিংবা ধোনিকে না নামিয়ে পান্ডিয়াকে নামানোই হয় দ্রুত রান তোলার জন্য। পান্ডিয়া তাতে সফল হন। দ্রুত ২৭ বলে ৪৮ রান করে আউট হন পান্ডিয়া। দল ততক্ষণে ৩০১ রানে চলে যায়। শেষ ১৩ ওভারে ১৩২ রান করে ভারত। ধাওয়ান আউটের পর পান্ডিয়া নেমে দ্রুত রান তুলেন। এরপর মহেন্দ্র সিং ধোনি ১৪ বলে ২৭ রান করেন। শেষদিকে অসাধারণ ব্যাটিং করেন ভারত ব্যাটসম্যানরা। বিশেষ করে কোহলি। অস্ট্রেলিয়া সামনে পড়লেই যেন গর্জে উঠেন কোহলি। ৫০তম হাফসেঞ্চুরি করার পর সেঞ্চুরির দিকেও এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু ওভার না থাকায় সেঞ্চুরি হয়নি। যখন ৭৭ বলে ৮২ রান করেন, তখন আবার আউটও হয়ে যান। তখন অবশ্য ৪৯.৫ বল ছিল। লোকেশ রাহুল শেষপর্যন্ত ১১ রানে অপরাজিত থাকেন। স্কোরবোর্ডে ৩৫২ রান যোগ করে ফেলে ভারত। মার্কাস স্টইনিস ২ উইকেট নেন। কিন্তু কামিন্স, স্টার্ক, কোল্টার নেইল, জাম্পারা ব্যর্থ হন। ভারতের ব্যাটিং যে কতটা শক্তিশালী, তা বুঝিয়ে দিলেন ভারত ব্যাটসম্যানরা। কোহলিতো সবসময়ই ভরসাবান ব্যাটসম্যান। তার ওপর সব ম্যাচেই দল ভরসা করে। কিন্তু অসিদের রানের চাপে ফেললেন আসলে ধাওয়ান। তিনি সেঞ্চুরি করে স্কোরবোর্ডে অনেক রান যোগ হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেন। সেই সম্ভাবনায় হেলায় ভেসে ভারতও সাড়ে তিনশ রানের পাহাড়ে চড়ল। এই পাহাড় পাড়ি দিতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। অসিদের হারিয়ে বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় জয় তুলে নিল কোহলির দল ভারত।
×