ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণের শৈল্পিক প্রতিবাদ বর্জ্য নামতা

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ১০ জুন ২০১৯

 পরিবেশ দূষণের শৈল্পিক  প্রতিবাদ বর্জ্য নামতা

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রদর্শনালয়ে প্রবেশ করতেই চমকে যেতে হয়। নজর পড়ে দুই পাশের দেয়াল থেকে নেমে আসা দুটি তারের দিকে। সেই তারে ঝুলে আছে চিপস, লবণ, আটাসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানা পণ্যের মোড়ক। প্লাস্টিকের মোড়কগুলো একটার ওপর আরেকটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে কিছুটা গোলাকার রূপ নিয়ে শূন্যে ভাসছে বর্জ্যগুলো। আবর্জনায় আবৃত সেই গোল বস্তুর নিচেই আছে সবুজের হাতছানি। একটি চৌকোণা মৃৎপাত্রে ডালপালা মেলে উর্ধমুখী হয়ে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট বৃক্ষরাজি। প্রতিদিনের ফেলে দেয়া পণ্য থেকে গড়া শিল্পকর্ম মননে ছুঁড়ে দেয় ভাবনার আধার। মনে করিয়ে দেয় ক্রমাগত পরিবেশ দূষণে মানুুষের অসচেতন মনোবৃত্তির কথা। নারায়ণগঞ্জের নদী-নালা, পথঘাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কুড়িয়ে আনা এমন প্লাস্টিক আবর্জনা, দূষিত নদীর পানিসহ নানা নমুনায় সাজানো হয়েছে প্রদর্শনীটি। মনুষ্য অবহেলায় পরিবেশ বিনষ্টের বিরুদ্ধে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার সাক্ষ্যবহ শিল্পায়োজনটির শিরোনাম ‘বর্জ্য নামতা’। শিল্পীদের প্ল্যাটফর্ম দাগ আর্ট স্টেশন আয়োজিত প্রদর্শনীটি চলছে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের শিল্পীদের পরিচালিত শিল্পালয় কলাকেন্দ্রে। ভাঙ্গারির দোকান থেকে শিশুদের পরিত্যক্ত খেলনা সংগ্রহ করে শিল্প সাজিয়েছেন খন্দকার নাসির আহাম্মদ। সেটির শিরোনাম দিয়েছেন বর্জ্য নামতা। শিশুখাদ্যের মোড়কের সঙ্গে ভাঙ্গা ছাতার ডাঁটির ব্যবহারে তৈরি রঙ্গিলা ছাতাটি দিব্যি ঝুলে আছে ছাদের উপর থেকে নিচের দিকে। এটি নির্মাণ করেছেন রঞ্জিত কর্মকার। লিটন সরকারের জাল শীর্ষক কাজটি বেশ নান্দনিক। উপস্থাপন করেছেন হাল ফ্যাশনের এক নারীর অবয়ব। আর এটি গড়তে শিল্পী ব্যবহার করেছেন আদার বস্তা, পলিথিন, বোতাম ও ডালের দানা। পরিত্যক্ত ফিল্টারের সঙ্গে ভাঙ্গারির দোকান থেকে সংগৃহীত প্লাস্টিকের বোতল-ব্যাগ এবং টুথব্রাশ ও চিপসের প্যাকেট দিয়ে ফিল্টার নামের শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেছেন মোহাম্মদ বদরুল আলম। আলোকচিত্রের মাধ্যমে ভয়াবহ দূষণে আক্রান্ত নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন দূষিত নদী ও খালের চিত্র মেলে ধরেছেন মুনতাসীর মঈন। ব্যবসা শিরোনামের শিল্পকর্মে শিল্পী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, প্রতিবছর আমরা ১৬০ মিলিয়ন প্লাস্টিক উৎপাদন করছি। যার ১০ ভাগ ফেলছি সমুদ্রে। সেসব প্লাস্টিকে মারা যাচ্ছে ১০ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী। আমাদেরকে যদি প্লাস্টিক দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? শিশুদের স্কুল থেকে সংগৃহীত চিপসের প্যাকেট দিয়ে সুমনা আক্তারের গড়া শিল্পের শিরোনাম ‘একটি নদীর গল্প’। শিল্প গড়তে ধলেশ্বরী নদীর পারে গেছেন রুহিত ভক্ত। সেখান থেকে কুড়ানো কীটনাশক, দুধের প্যাকেট, চালের বস্তা, জর্দার কৌটা, চানাচুরসহ নানা পণ্যের মোড়কে গড়া কাজটির শিরোনাম দুঃস্বপ্ন। একটি স্টিলের ফ্রেমের চারপাশে ঝুলছে বেশ কিছু কাঁচের বোতল। বোতলবন্দী হয়েছে নারায়ণগঞ্জের চারটি নদী ও দশটি খালের দূষিত পানি। মৃত্যুর প্রতীক শীর্ষক কাজটি করেছেন জাহিদ হৃদয়। এভাবেই মনুষ্য অসচেতনতায় পরিবেশ দূষণের নানা প্রতীকী দৃশ্যকল্প মেলে ধরা অন্য ছয় শিল্পী হলেনÑ রাজীব শীল, ফাহমিদা আক্তার, নিক্কন দাস, ফাতেমা আহমেদ, ফয়সাল হোসেন ও সৈকত ম-ল। সব মিলিয়ে ১৪ শিল্পীর শিল্পের ফসল বর্জ্য নামতা। প্রদর্শনীর কিউরেটিং করা দুই শিল্পী হলেন ওয়াকিলুর রহমান ও কবির আহমেদ মাসুম। প্রদর্শনী প্রসঙ্গে ওয়াকিলুর রহমান বলেন, এটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছে নারায়ণঞ্জ সিটি কর্পোরেশন প্রাঙ্গণে। শিল্পীরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতি শুক্রবার সিটি কর্পোরেশনের পাঠাগারের সামনে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সিটি কর্পোরেশনও মানুষের মাঝে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্প প্রকল্পটি সাদরে গ্রহণ করে। অন্যদিকে দর্শকদের মাঝেও এটি সাড়া ফেলে। পরিবেশ বিষয়ে তাদের ভেতরের ভাবনাকে উসকে দিয়েছিল আয়োজনটি। নারায়ণগঞ্জের আট শিল্পীর সঙ্গে ঢাকার ছয় শিল্পীর ঐক্যবদ্ধ কাজটি ছিল একই সঙ্গে নান্দনিক, শ্রমসাধ্য ও ভাবনাতাড়িত। শিল্প গড়তে তারা সেমিনার, ফিল্ড ভিজিটসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভেবেই তারা এটা করেছেন। প্রতিনিয়ত আমরা যে জিনিসগুলো ফেলে দিচ্ছি সেগুলো কিভাবে ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে-শিল্পের আশ্রয়ে সেই চিন্তাটা ছুঁড়ে দিয়েছে শিল্পীদল। তাদের সেই ভাবনাকে ঢাকার দর্শকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদে পরবর্তীতে প্রদর্শনীটির আয়োজন করে কলা কেন্দ্র। দেড় মাসব্যাপী চলমান প্রদর্শনীটি শেষ হবে কাল মঙ্গলবার। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×