ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আদুরে লাভ বার্ডের আদি নিবাস মাদাগাস্কারে ওরা ‘স্বর্গের পাখি’

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ১০ জুন ২০১৯

 আদুরে লাভ বার্ডের আদি নিবাস মাদাগাস্কারে ওরা ‘স্বর্গের পাখি’

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ বনের পাখি। তবে এ দেশের বনের নয়। মধুময়তার ছোট্ট মিষ্টি পাখি। কখনও উড়ে এসে খাঁচায় বন্দী হয়েছে, কখনও উড়োপথে (উড়োজাহাজে) মানুষের সঙ্গে এসেছে। ঘরে উঠেছে। ওদের আবাস বিশেষ ধরনের খাঁচা। বন্দী হলেও মানুষের সঙ্গেই বসবাস। এই বন্দী মায়ার, ভালবাসায় গাঁথা-পারিবারিক বন্ধনের। তারপরও তো পাখি। কোন পাখি না চায় মুক্ত আকাশে উড়তে। তবে এদের বৈশিষ্ট্য মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা পাওয়া। সুর মিলিয়ে গান গেয়ে খেললে স্বর্গীয় ভুবন গড়ে তোলে। বিদেশী বংশোদ্ভূত এমন নানা ধরনের পাখি বাংলাদেশে অভিবাসী হয়েছে। বিদেশী পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ও আদুরে পাখি লাভ বার্ড। এ ছাড়াও আছে বাজেরিগা, কাকাটাইল, সালকুলুর, লরি, ফিন্স, জাভা, ইন্ডিয়ান রিং নেক, আফ্রিকান গ্রে প্যারট, কাকাতুয়া, তিতির, সাদা চিবুক তিতির, পাহাড়ী তিতির, বাঁশবনের তিতির, কয়েক ধরনের বটেরা, ট্রাইগোপ্যান, চিত্রা মুরগি, সারলী, নীল ময়ূর, নীলশির, চখাচখি ইত্যাদি। এদের মধ্যে চখাচখির আবার কয়েক জাত। ‘জলার তিতি’ নামে পরিচিত চখাচখি পরিযায়ী, যা দেশে শীত মৌসুমে আসে। বসন্তে যে পাখি আসে তা পান্থ পরিযায়ী। এসব পাখির মধ্যে বিদেশী পাখি পথ ভুলে উড়ে আসে। একক পাখির বৈশিষ্ট্য একেক রকম। এর মধ্যে বিদেশী বংশোদ্ভূত সবচেয়ে আদুরে পাখি লাভ বার্ড। লাভ বার্ড- বাংলায় ভালবাসার পাখি। আফ্রিকা মহাদেশ নিবাসী। কখন কিভাবে এরা উপমহাদেশে উড়ে এলো, না কেউ ওদের নিয়ে এলো তা স্পষ্ট নয়। মাদাগাস্কারের এই পাখিকে বলা হয় স্বর্গের পাখি। প্যারোট বা টিয়া গোষ্ঠীর এই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এরা জোড়ায় থাকতে চায়। লাভ বার্ডের আটটি জাত। কোনটি সবুজে হলদে লাল, কোনটির হলুদ পিঠ, বর্ণিল ঠোঁট, লম্বা লেজ। কোনটির মেরুন রঙের ঠোঁট, হলুদ রঙের বুক। এদের গায়ের মিষ্টি রং মন ভুলিয়ে দেয়। এরা ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি লম্বা। ছোট হলেও পরিশ্রমী। শীতের চেয়ে উষ্ণতা পছন্দ। এরা সামাজিক। খাঁচায় একাকী থাকতে পারে না- সঙ্গী খোঁজে। খাবারের মধ্যে পছন্দ আম, আঙ্গুর, পেঁপে, সবজি। যে বাড়িতে পোষ মানে সে বাড়িতে নতুন কাউকে দেখলে ভয় পায়। ভাব করলে ভাব বিনিময় করে। কখনও কখনও অভিমানে লুকোচুরি খেলে। তারপর চুপি চুপি ডাকে ইশারা করে। ছন্দে নেচেও উঠবে। এক সময় সুর তুলে এমন ভাবের সৃষ্টি করে, দেখে মনে হবে যেন স্বর্গ নেমেছে। যে একবার লাভ বার্ডকে পোষ মানিয়েছে সে কখনও ভুলতে পারে না। লাভ বার্ডসহ বিদেশী পাখির জেন্ডার (স্ত্রী পুরুষ) চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। শুধু চোখের দেখায় কোন পাখিটি কোন সেক্সের (লিঙ্গ) তা বোঝা যায় না। এতদিন ভারত ও থাইল্যান্ডে ডাইঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) সেক্সিং প্রযুক্তিতে এসব পাখির লিঙ্গ নির্ধারণ করা হতো। বাংলাদেশের শৌখিন পাখিপ্রেমী ও পাখি ব্যবসায়ীরা লাভ বার্ডের লিঙ্গ নির্ধারণ করে আনত ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে। এতে সময় ও খরচ বেশি। দিনে দিনে দেশে শৌখিন পাখিপ্রেমী অনেক বেড়েছে, যে সংখ্যা অন্তত ৭ লাখ। দেশের প্রতিটি স্থানে বিদেশী পাখি ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এ্যান্ড এ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের (সিভাসু) একদল গবেষক ডিএনএ সেক্সিং প্রকল্পের আওতায় লাভ বার্ডসহ কিছু বিদেশী পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সাফল্য পেয়েছেন। একটি সূত্র জানায় দেশে ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তি উদ্ভাবন এই প্রথম। সিভাসুর প্রধান গবেষক ছিলেন প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শুভাগত দাস। সঙ্গে ছিলেন আরও ছয়জন। তারা বিদেশী পাখির রক্ত ও বুকের পালকের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তিতে মলিকুলার কম্পোজড, বডি সেল, ক্রোমোজম পরীক্ষা করে সব পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সক্ষম হন। যা এ দেশের গবেষণায় বড় সাফল্য। বগুড়ার সূত্রাপুর এলাকার পাখি ব্যবসায়ী মীর এনায়েত আলী জানালেন, প্রকৃতিগতভাবেই স্ত্রী ও পুরুষ পাখি বাইরে থেকে একই রকম। দেশী কিছু পাখির আচরণ দেখে আঁচ করা যায় কোনটি কোন লিঙ্গের। স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গের পাখির প্রজননে বংশ বিস্তার হয়। বিদেশী পাখি যেমন লাভ বার্ড, বাজেরিগা, কাকাটাইল, সালকুলুর, লরি, ফিন্স, জাভা, ইন্ডিয়ান রিং নেক, গ্রে প্যারো ইত্যাদির লিঙ্গ চেনা খুবই কঠিন। এতদিন দেশে ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তির উদ্ভাবন না হওয়ায় শৌখিন পাখিপ্রেমী ও পাখি ব্যবসায়ীরা ওসব পাখির রক্ত এবং বুকের পালক বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে পাঠিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করিয়ে আনত। এখন দেশেই ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে লিঙ্গ নির্ধারণ সহজ হচ্ছে। আনাম বললেন, আগে বিদেশ ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছোট পাখি ব্যবসায়ী বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে আনতেন। লিঙ্গ না চেনায় প্রজননের মাধ্যমে এদের বংশবিস্তার করা যেত না। এখন সে সুবিধা পাওয়া যাবে। বিদেশ থেকে বেশি দামে আর পাখি কিনতে হবে না। প্রায় দশ বছর ধরে পাখি বেচাকেনা করছেন জনৈক বেলাল। বললেন, তিনি কিছুটা চিনতে পারেন কোনটি স্ত্রী, কোনটি পুরুষ। গভীরভাবে এদের ঠোঁটের রং দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়। তিনি বিদেশী পাখি বিক্রি করেন ২ থেকে ১০ হাজার টাকায়। বার্ড ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশনের একটি সূত্র মতে দেশে শৌখিন পাখিপ্রেমী ও খামারির সংখ্যা বাড়ছে। তারা বিদেশী পাখি পোষ মানিয়ে পালন করে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক বাড়িতে বিদেশী পাখির অভিবাসন হয়েছে। বগুড়ার গোহাইল রোডের ধারে, চার মাথা এলাকায়, শিবগঞ্জে বিদেশী পাখি বেচাকেনা হচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা অনেকেই লাভ বার্ডসহ বিদেশী পাখি পালন করছেন, বিশেষ করে লাভ বার্ড মনের দুয়ারে ঢুকে গেছে।
×