ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুশান্ত মজুমদার

গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ ॥ কালের পৃষ্ঠায় যার নাম

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১০ জুন ২০১৯

 গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ ॥ কালের পৃষ্ঠায় যার নাম

মৃত্যুর আগে অসুস্থ হলে বহুলাংশে রহিত হয় তাঁর চলৎশক্তি। চিকিৎসাজনিত ব্যয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসে আর্থিক অবস্থা। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে নিয়মিত জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটির নতুন সংস্করণ ছাড়া বন্ধ হয়ে যায় সাহিত্যের বই প্রকাশ। তবু দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা থেকে কালোপযোগী বিষয়ের বই ছাপার ব্যাকুলতা তাঁর ছিল। ধীরে ধীরে কমে আসছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষের সংখ্যা। বয়োকনিষ্ঠ একাধিকজনের অকালপ্রয়াণের পর অন্যরা গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সখ্য থেকে ধীরে আড়ালে সরে গেছেন। এক সময়ের সুহৃদজনরা তাঁর মৃত্যুর পর মানুষটি যাঁদের রেখে গেছেন তাঁদের অবস্থা জানার জন্য উঁকি দেননি। না, দোষ খোঁজা হচ্ছে না। মানুষ নবায়িত বন্ধুত্ব দিয়ে আবশ্যক পরিবর্তিত অবস্থান পূর্ণ করে থাকেন। উল্লেখ্য, ৯ জুন ২০১৭ সালে সম্পাদক ও প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের জীবনাবসান হয়। অধ্যবসায়ী পাঠক মাত্র জানেন যে, গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী হয়ে উঠেছিল দেশের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রকাশনা সংস্থা। বছর বছর পার করে বয়সী হলেও গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের গায়ে লাগতে দেননি প্রৌঢ়ত্বের ছোঁয়া। বরং সময় জয় করে সন্ধানী প্রকাশনী থেকেছে চরিত্রে সমকালীন। সময়ের ভেতর আছে ভাঙ্গা-গড়া, বন্ধ্যাত্ব ও জঙ্গমতা। নতুন সময়ের নতুন শর্ত, নতুন বিষয়ের মধ্য দিয়ে সন্ধানী প্রকাশনী পার করেছে প্রায় পাঁচটি দশক। এই পাঁচ দশকের মধ্যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বীয় দেশ। যুদ্ধের অর্জিত চেতনা ও শত ফুল বিকাশে প্রতিশ্রুতি ধারণ করে দেশের প্রকাশনায় সন্ধানী যোগ করেছে নতুন মাত্রা, অগ্রসর শিল্প-সাফল্য। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত সাহিত্য-সংস্কৃতির মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’ তাঁর জীবনের সায়াহ্নে এসে বন্ধ হয়ে যায়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আলোড়ন, সঙ্কটের মধ্যে স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে পত্রিকাটি সাময়িক বিরতি দিয়ে বের হয়েছে তিনবার। অনস্বীকার্য যে, সচিত্র সন্ধানীই ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৩ জুন ১৯৫৬ সালে। অল্প দিনের মধ্যে পত্রিকাটি দেশের আলোচিত পত্রিকা হয়ে দাঁড়ায়। সচিত্র সন্ধানী থেকে চালু হয় বর্ষ শুরু সংখ্যা প্রকাশের রেওয়াজ। এই বর্ষ শুরু সংখ্যায় বেরিয়েছিল জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ ও সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। সময়ের প্রয়োজনে নতুন আঙ্গিক, বিন্যাস এবং সময়োপযোগী সৃজনশীল রচনা, প্রচ্ছদ পরিচিতি, সম্পাদকীয়, ফিচার, নগরবাসীর উপভোগ্য ‘ঢাকা ডায়েরি’, গ্রাম-বাংলার বিষয়ের ‘বিশাল বাংলা’ হয়ে উঠেছিল পাঠকপ্রিয়। সচিত্র সন্ধানীর সামগ্রিক রূপ ও রুচি নির্মাণে এই পত্রিকার জন্য লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন দেশের জ্যেষ্ঠ স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিক শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কামরুল হাসান, শামসুর রাহমান, সুচরিত চৌধুরী, আনিস চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিসুজ্জামান, কাইয়ুম চৌধুরী, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রশীদ করিম, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, রাজিয়া খান, লায়লা সামাদ, রাবেয়া খাতুন, এটিএম আবদুল হাই, মাহ্মুদুল হক, আল মাহ্মুদ, শহীদ আখন্দ, পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, বেলাল চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মাহমুদ আল জামান, মালেকা বেগম, মফিদুল হক, সেলিনা হোসেন, মাকিদ হায়দার, শিহাব সরকার প্রমুখ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অস্থির, অস্থিতিশীল সময়ে একটি পত্রিকার ছাপার জন্য ছিল অসংখ্য বিষয়। এই বিষয় ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব। ওই সময় থেকে সস্তা বিনোদন উপহার দিয়ে পাঠকের পকেট হাতিয়ে নেয়ার সেরা ফন্দি শুরু। সচিত্র সন্ধানী বিপরীত স্রোতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে থাকে। কত লোকপ্রিয়, তাৎক্ষণিক মানসিক আরামের খোরাক ফেলে সন্ধানী বেছে নেয় সেই শিল্প-সাহিত্য-বাঙালী সংস্কৃতি যে সংস্কৃতির চরিত্র পরিচ্ছন্ন। শিল্প-সাহিত্য বিভিন্ন শাখার উন্নত, সফল কাজ নিয়ে সচিত্র সন্ধানী বের করেছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-সাংবাদিক-খেলোয়াড়-চিত্র-সঙ্গীত-মঞ্চ-চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে অনেক কৃতীজন সন্ধানীর বিষয় হয়ে এসেছেন। আজও তাই শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস বা গবেষণামূলক কাজে সচিত্র সন্ধানীর পুরনো সংখ্যার খোঁজ পড়ে। সন্ধানীর বিশেষ সংখ্যা লেখা-রেখা-চিত্রে ছিল সাহিত্যের সেরা সম্ভার। অনেক সুধীজনের কাছে এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা যত্নের সঙ্গে বাঁধাই অবস্থায় আছে। আজ দেশে সুলভ কম্পোজ, মুদ্রণ ব্যবস্থার সুবাদে পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থার ছড়াছড়ি। সরকারী অর্থে বিভিন্ন একাডেমি প্রকাশ করছে বই ও বিভাগীয় পত্রিকা। বইয়ের বিষয় ও মুদ্রণ সৌকর্যে আজ অব্দি সন্ধানী প্রকাশনীকে এরা ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আশার কথা, বাংলাদেশের প্রকাশকদের সম্মিলিত শ্রমে প্রকাশনা শিল্পের দৃষ্টিনন্দন শ্রী বিকশিত হচ্ছে; এর পেছনে সন্ধানীর অবদান কম নয়। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ রুচি পাল্টাবার দায়িত্ব নিয়ে দেশের জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকদের বই সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বের করেছেন। আপ্তবাক্যের মতো শোনালেও সন্ধানী প্রকাশনী দাবি করতে পারে, লেখক নয়, বিষয় ছেপেছে তারা। সন্ধানী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে একই লেখকের লেখার কেবল মানসম্পন্ন উত্তম অংশ। যদিও রচনা-গুণ প্রাধান্য দেয়ার জন্য সন্ধানীর অনেক বই গড়পড়তা পাঠকের মনোযোগ পায়নি, পেয়েছে ধীমানদের কাছে যথাযথ শিল্পের স্বীকৃতি। প্রকাশক হিসেবে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ মনে করতেন, একজন লেখকের এটাই তো বড় অর্জন। আজ বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পের যে পরিবর্তন, বিমূর্ত প্রচ্ছদের ব্যবহার, শিল্পীর আঁকা ছবির সংযোজন তার গোড়াপত্তন করে সন্ধানী প্রকাশনী। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী যাঁর হাত দিয়ে বাংলাদেশে বইয়ের প্রচ্ছদের বিকাশ, তিনি ছিলেন সন্ধানীর সঙ্গে একীভূত। সন্ধানী প্রকাশনী মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য প্রকাশে এদেশের পথিকৃৎ। জাতির শ্রেষ্ঠ কীর্তি নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের যে চিন্তাধারা, তার সুবিন্যস্ত লিখিত রূপের আয়ুষ্মান ও সফল অংশ গ্রন্থাকারে প্রকাশের কৃতিত্ব সন্ধানী প্রকাশনীর। প্রকাশক হিসেবে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ তাঁর মতো সন্ধানী প্রকাশনীকেও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনে নিবিড় অঙ্গীকার। আজও বহুকোণ থেকে বিভিন্ন নিরিখে সাহিত্যের প্রধান বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। লেখকরা যা লিখেছেন, তাঁদের একক গল্প-কবিতা নিয়ে সন্ধানী প্রকাশনী বের করেছে মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যের সিরিজ। এক এক করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও অর্জিত চেতনা যখন ক্ষয় হচ্ছে, নস্যাৎ হচ্ছে সুফল তখন মুক্তিযুদ্ধকে স্থায়ীভাবে অক্ষরে বেঁধে রেখেছে সন্ধানী প্রকাশনী। ভাবীকালের পাঠকও এই প্রকাশনীর গল্প-কবিতা বইয়ের নান্দনিক সঞ্চয় থেকে পাবে মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস। স্বল্পবাক, প্রচারবিমুখ, অন্তরালপ্রিয় গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ ৭৮ বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর একক প্রয়াসে পত্রিকা ও প্রকাশনা যে সৃষ্টির উৎসব রচিত হয় তার অমলিন স্মৃতি সারস্বত সমাজে এখনও সজীব। মানুষটির বিঘ্ন-ভাঙ্গা উদ্যোগ, সংস্কৃতিবানের সেবা, বাণিজ্যবুদ্ধি উপেক্ষা করে সৃজনশীলের ভরসা করার মতো স্থিতি দেয়ার বিষয়ে লক্ষ্যস্থির তাঁর শ্রম আমাদের ঋণী করেছে। শুদ্ধতম নাগরিক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদকে আমরা অবশ্যই মনে রাখব। লেখক : কথা সাহিত্যিক
×