ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশে ২২ শতাংশ নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায়

পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচটি শিশুর দুটি খর্বকায়

প্রকাশিত: ১০:৩১, ৯ জুন ২০১৯

  পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচটি শিশুর দুটি খর্বকায়

নিখিল মানখিন ॥ শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না। ১৯৯৪ সালে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর হার ছিল ৪৬ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে উন্নীত হয় ৫৫ শতাংশে। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও এই হার আর বাড়েনি। তা ৫৫ শতাংশেই স্থির রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, বিশ্বের সর্বত্র এ হার হওয়া উচিত ৯০ শতাংশ। ৬ মাস থেকে পূর্ণ ২৩ মাস বয়সী মাত্র ২৩ শতাংশ শিশুকে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য খাদ্য খাওয়ানো হয়। এর প্রভাব পড়েছে শিশুপুষ্টির ওপর। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচটি শিশুর দুটি খর্বকায়। বাংলাদেশে ২২ শতাংশ নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায়। ইউনিসেফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ কম পায়। ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ৯৯ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৯৮ শতাংশ শিশুকে শিশুকালে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। বাংলাদেশ ছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে এই হার ৯৪ থেকে ৯৭ শতাংশ। বাংলাদেশে নবজাতকদের মাত্র ৫১ শতাংশকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা হয় এবং ছয় মাসের কম বয়সী ৫৫ শতাংশ শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্থূল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ স্থূল ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। পরিসংখ্যান বলছে, স্থূল হওয়ার প্রাদুর্ভাব পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি। আর প্রতিবেদন বলছে, স্থূলতা কমানোর ক্ষেত্রে দেশ সঠিক পথে নেই। স্থূলতার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে, ২২ শতাংশ নবজাতক জন্মের সময় কম ওজন নিয়ে জন্মায়। আর রক্তস্বল্পতায় ভুগছে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু। পুষ্টির উন্নতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য কর্মকা- ও জবাবদিহির কথা এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্য দেশগুলোর পুষ্টি পরিস্থিতির অগ্রগতি পরিমাপের জন্য কিছু সূচক ব্যবহার করে। সেই সূচক ধরে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, খর্বতা ও অতি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঠিক পথে আছে। তবে কৃশতা ও রক্তস্বল্পতা কমানো এবং শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সঠিক অগ্রগতি হচ্ছে না। প্রতিবেদন বলা হয়েছে , পুষ্টি জ্ঞানভিত্তিক বিষয়। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সমাজের সবচেয়ে ধনী শ্রেণীর ২০ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অপুষ্টি দূর করার জন্য জনস্বাস্থ্য পুষ্টি কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। পুষ্টির জনবলের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অপুষ্টি মোকাবেলায় বিশ্বের প্রতিটি দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। জীবনের প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশু যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। আর জন্মের ৬ মাস পর শিশুকে বাড়তি খাবার খাওয়াতে শুরু করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার বলতে শুধু দামী খাবারকে বুঝায় না। অনেক পুষ্টি উপাদান বাড়ির আশপাশেই রয়েছে, যা স্বল্প মূল্যে সংগ্রহ করা সম্ভব। পারিবারিক খাবার থেকেই আলাদা করে (নরম ও গুঁড়া করে মাখিয়ে) শিশুকে দেয়া যায়। মায়ের দুধের পরিবর্তে কৌটার বা বাজারের দুধ খেলে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে এ শিক্ষাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে পুষ্টি ধারণা বাড়বে এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ও মায়ের সংখ্যা কমে আসবে। এদিকে জাতীয় পুষ্টিনীতি-২০১৫ চূড়ান্ত করেছে সরকার। পুষ্টিনীতিতে পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্যসহ আটটি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে নতুন কার্যক্রম ও কৌশল গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। অপুষ্টির বিভিন্ন কারণ চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে জনগণের যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে গ্রহণ করা হবে বিশেষ ব্যবস্থা। হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি কার্যক্রমে মাঠ পর্যায়ে পুষ্টিবিদ নিয়োগ করা হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপকেন্দ্র, পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে পুষ্টিসেবা প্রদানের উপযোগী করে তোলা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুষ্টিশিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করা হবে বলে পুষ্টিনীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পুষ্টিনীতিমালা কার্যকর হলে দেশের মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থারও ব্যাপক উন্নতি পুষ্টিনীতিতে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে জাতীয় ও পুষ্টিনীতি তৈরি হওয়ার পর গত দুদশকে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে পুষ্টির স্তর কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। মানবিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপুষ্টি দূর করা জরুরী। দেশব্যাপী শহর ও গ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ওজনাধিক্য, স্থ’ূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার ও অস্টিওপোরোসিস (নরম হাড়) বর্তমানে পুষ্টিজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শারীরিক সক্রিয়তার ঘাটতি, কায়িক শ্রমে অনীহা, ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভাস এবং অলস জীবন-যাপন এর জন্য দায়ী। পুষ্টিনীতি সরকারের গৃহীত স্বাস্থ্য, খাদ্য, কৃষি, পরিবেশ ও শিক্ষাসহ অন্যান্য জাতীয় নীতির পরিপূরক হিসেবে বাস্তবায়িত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বয়োসন্ধিকালীন মেয়েদের এক-চতুর্থাংশ অপুষ্টির শিকার। প্রজননক্ষম বয়সের প্রতি ৮ জন নারীর একজন খর্বকায়। খর্বকায় নারীর সন্তান জন্মদানের সময় জটিলতার ঝুঁকি থাকে। একই কারণে তাদের গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেশি থাকে। ফলে নবজাতকের কম জন্মওজনের আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে গর্ভধারণ এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে কম জন্মওজনের শিশুর হার অনেক বেশি। একজন খর্বকায় মায়ের কম জন্মওজনের শিশু জন্ম দেয়ার আশঙ্কা সব সময় থাকে। আবার শিশুটি বয়স্ক হওয়ার পারও খর্বতা কাটিয়ে উঠতে পারে না।
×