ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেতে নাহি দিব... আপন ঘর ফাঁকা করে মহানগরীর শূন্যস্থান পূরণের পালা

প্রকাশিত: ১০:১২, ৮ জুন ২০১৯

 যেতে নাহি দিব... আপন ঘর ফাঁকা করে মহানগরীর  শূন্যস্থান পূরণের পালা

সমুদ্র হক ॥ আপন ঘর ফাঁকা হয়ে মহানগরীতে শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার পালা শুরু হলো। আজ শনিবার ঈদের ছুটি শেষ। ঈদের টানা ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে কর্মস্থলে ফেরার তাড়া। এবারের ঈদের আনন্দেও ছিল কিছুটা ভাটা। সাধারণত ঈদের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে আনন্দ ধারা শুরু হয় ছোটদের ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। ওদের আনন্দেই বড়দের আনন্দ। হাতে মেহেদির নক্সা, ডিজিটাল শব্দযন্ত্রে হৈ হুল্লোড়। বড়দের কিছু বাকি রইল কি! এমন ভাবনায় বাজারে তুঙ্গে ওঠা কেনাকাটা। অতিথি আপ্যায়ন ও ঘর সাজানোর নানা আয়োজনের প্রস্তুতির পালা ঘরে ঘরে। শুরু হওয়া এমন পালা থমকে যায় রাত সাড়ে আটটায় শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়নি ঘোষণায়। এই ঘোষণার পর ঈদের আগের রাতের কর্মসূচীগুলোকে বিরতি দিয়ে মানুষ যখন রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি শেষ করেছে তখনই আধা নীরব শহরে ঈদের আগের রাতের চাঞ্চল্য ফিরে পেল। যারা জানত না তারাও বাইরের শোরগোলে জেগে উঠে চোখ কচলাতে বলতে থাকে ‘এ কেমন রঙ্গ দাদু’। প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলল, প্রযুক্তির এত অগ্রযাত্রায় সন্ধ্যার সিদ্ধান্ত দিতে এত দেরি হলো! ঈদের আগের রাতের আনন্দ ভন্ডুল হয়ে গেল। এভাবেই ঈদ উদযাপনের আনন্দের রেশ শেষ হওয়ার পরই রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙ্ক্তি ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর...’ সমুখে এসেছে। ঢাকার বাইরে আপন ঘরে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে স্বজনের ক্ষণিকের আগমনে হেসে উঠেছিল ঘর ও ঘরের মানুষ। এখন কর্মস্থলে ফেরার প্রস্তুতির পালায় আপনজনের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে অবচেতনেই। বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে নেয়ার সময় কখনও মা মেয়েকে বলছে -তুই তো আচার, নারিকেলের নাড়ু পছন্দ করিস, এই বয়্যামটা তুলে নে। কখনও বলছে তোর জন্য এই খাবার করে রেখেছি, ঘরে গিয়ে ফ্রিজে রেখে দিস। আরও কত কি...। যেন মেয়েকে সব কিছু উজার করে দিতে পারলে মায়ের হৃদয় ধন্য হয়। মেয়েও তেমনি বলে ওঠে- এত কি দিচ্ছ। এত নেয়া যাবে না। তবুও কি মায়ের মন মানে। মনে হয় কতদিন পর ছেলে-মেয়েরা এসেছে, আবার কত দিন পর আসবে। জামাই পুত্রবধূ নাতি-নাতনি থাকলে তো ঈদ শেষ হওয়ার সঙ্গেই মায়ের চোখের জল গড়তে শুরু হরে। মনে হতে থাকে, ঘরটি কতই হৈচৈ আর চাঞ্চল্যে ভরে ছিল। ফের ফাঁকা হয়ে যাবে। যখন ঘর ছেড়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয় তখন মায়ের স্নেহের আবেগের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এতক্ষণ যে বাবা অনেক কষ্টে আবেগ চেপে রাখতে পেরেছিলেন তার চোখেও জল গড়িয়ে পড়ে। শুধু বুঝতে দেন না। দুয়ারে গাড়ি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা- ‘গভীর ক্রন্দন... তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়।’ এটাই বাস্তব নিরন্তর। ঈদে রাজধানী ফাঁকা হয়ে গ্রাম ও শহর ভরে উঠেছিল। এবার শহর ফাঁকা হয়ে রাজধানী ঢাকা পূরণ হতে চলেছে। সামজিক মাধ্যমে যারা পোস্ট দিয়েছিলেন ‘আহা ঢাকা যদি সব সময় এমন ফাঁকা হতো’ তারা এখন কি পোস্ট দেবেন- কংক্রিটের বনে কয়েকটা দিন সুন্দর কাটল। ফের কোলাহল! ফের জ্যাম, ফের শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ কত কী! তাদের মনও কি কংক্রিটের মতো শক্ত গাঁথুনি হয়ে গিয়েছে। একজন বললেন, এগুলো তো সস্তা সেন্টিমেন্ট। সত্যিই কি! হয়তো মহানগরীর কান্না তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এবারের ঈদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য- গ্রামে ঈদের আনন্দেরও পালা বদল ঘটছে। অনেকেই ঈদের ছুটিতে গ্রামে যান। যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে গ্রামের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে ফিরে পেতে চান সেই শৈশব ও কিশোর বেলাকে। যে স্মৃতি রেখে এসেছেন নিজ গ্রামে। স্মৃতির সেই পাতা মেলতে কখনও সহসা গ্রামে যাওয়া হতো না। এখন গিয়ে দেখেন- বর্তমানে গ্রামে পাকা সড়ক, উন্নত যোগাযোগে ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়িত হয়ে নগর জীবনের মতো আলোকিত পথঘাট। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে কেবল সংযোগসহ রঙিন টেলিভিশন। রেফ্রিজারেটর, ওভেন আছে কোন বাড়িতে। ল্যাপটপ, ট্যাব সবই মেলে। গ্রামের তরুণ-তরুণীদের হাতে স্মার্ট ফোন। ওয়াইফাই সংযোগ। গ্রামের বধূ এখন আর হেঁসেলে (মাটির চুলা) লতাপাতা খড়ি ও তুস দিয়ে রান্না করে না। লিক্যুফাইড পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাসের চুলায় রান্নায় অভ্যস্থ হয়েছে। গ্রামের মানুষের জীবন মান এখন পাল্টে গিয়েছে। বিনোদনের সকল সুবিধা শহরের সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছে গ্রামে। কি নেই গ্রামে! যাদের মোটর গাড়ি আছে তারা তো স্বচ্ছন্দেই ঈদে গ্রামে চলে যান। সাধারণ মানুষ বাস কোচ ও ট্রেনে চড়ে মনের টানে ছুটে যান নিজ গ্রামে। পাবলিক পরিবহনও উন্নত হয়েছে। তবে গ্রামের সেদিনের সেই প্রকৃতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। গাছগাছালি আছে তবে তা বিচ্ছিন্ন। বাড়িঘর উন্নত। নদী তীরের সেই খেয়াঘাট নেই। নেই সেই বটতলা ও মাচাং। ঝাউগাছ নেই, সন্ধ্যায় জোনাকি জ¦লে না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় না। তার বদলে ঝিঁঝিঁ পোকা নামের খেলা (ক্রিকেট) দেখা যায় টিভি সেটে। পেঁচাও এখন রাত ঠাওর করতে না পেরে প্রহর গুনতে ভুল করে। গ্রামের উন্নয়নের মধ্যে আসে ঈদ। নিজ বাড়িতে ঈদ উৎসবে অংশ নিতে ঢাকা ছেড়েছে অনেক মানুষ। গত বছর মহাসড়কে ছিল ভোগান্তি। যানজটে নাকাল হওয়া মানুষ গন্তব্যে পৌঁছেই বলাবলি করেছিল, আর নয়। এবার তারা বলছে, এবার সড়ক পথে যাত্রা অনেকটা স্বস্তির ছিল। তবে রেলপথ, জলপথ ও উড়ো পথে সময় ঠিক থাকেনি। মঙ্গলবার (৪ জুন) উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে যান চলাচল জ্যামের ফেরে পরে। এই দিন নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা যায়নি। সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সমস্যার সমাধানও দ্রুত হয়, এমনটি বলেছেন যাত্রীরা।
×