ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইফাইলিংয়ের নামে কাগুজে ফাইলের স্ক্যান কপি!

প্রকাশিত: ১০:১০, ৮ জুন ২০১৯

 ইফাইলিংয়ের নামে কাগুজে ফাইলের  স্ক্যান কপি!

রশিদ মামুন ॥ ইফাইলিং। বিশ্বে প্রচলিত এই পন্থা এখনও আমাদের দেশে নতুন। প্রশাসনে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকার মনে করছে ইফাইলিং বাস্তবায়ন জরুরী। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে শুরু করে সরকারী সব দফতর আর কার্যালয়ে এখন ইফাইলিং বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ইফাইলিং এর নামে যা হচ্ছে তা কি আসলেই ইফাইলিং। নাকি কাগুজে ফাইলের স্ক্যান কপি মাত্র। ইফাইলিংয়ের অর্থ হচ্ছে কোন একটি ডকুমেন্ট কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই ফাইল ঘুরবে এক কার্যালয় থেকে অন্য কার্যালয়ে। এই ফাইলের আদেশ নির্দেশ সবকিছুই কম্পিউটারের মাধ্যমে দিতে হবে। এতে দুই ধরনের সুবিধা একদিকে এতে কোন কাগজ প্রয়োজন হবে না। অন্যদিকে ফাইল ডাকে অথবা মানুষের মাধ্যমে পাঠাতে যে সময় অপচয় হয় তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু দেশে যেভাবে ইফাইলিং করা হচ্ছে এখানে এই দুই উদ্দেশের কোনটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেশে ইফাইলিং কিভাবে হয় জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, প্রথমত একটি কার্যালয় থেকে কাগজের ফাইল আসে। সেই ফাইলটি স্ক্যান করে কম্পিউটারে ঢুকানো হয়। বলা হচ্ছে এটিই ইফাইল। এবার সেই ফাইলটি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু পদস্থ ব্যক্তিরা দেশে থাকলে সাধারণত কম্পিউটারের স্ক্যান ফাইলটির বদলে কাগজের ফাইলটিই দেখে থাকেন। তাহলে এটি কেমন ইফাইলিং এই প্রশ্ন উঠছে। যদি কাগজের ফাইলটিই দেখতে হয় তাহলে ইফাইলিং কেন বলা হয়। এমন প্রশ্ন করছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু ই-ফাইল মূলত স্ক্যান ফাইল সেহেতু এখানে চাইলেও কোন ধরনের পরিবর্তন পরিবর্ধন বা কোন আদেশ দেয়া সম্ভব না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে স্ক্যান কপির উপর লেখা সম্ভব নয়। সরকারের ঘোষণা বলছে একেবারে কাগজের ফাইল তুলে দেয়া হবে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ সরকারী ফাইল তৈরি করতে এখন আর কাগজ ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে কাগজের ফাইল ছাড়া কোন কাজই হয় না। ফলে ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতা সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ফাইলগুলো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে আসে অনুমোদনের জন্য। এখানে কাগজের ফাইলটি আসার পর একটি নোটিস প্রস্তুত করেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তার প্রস্তুত করা ফাইলটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবার কম্পিউটার অপারেটর টাইপ করে কাগজে প্রিন্ট দেন। এই প্রিন্ট কপি কাটাছেড়া করে একজন ডেস্ক অফিসার চূড়ান্ত করেন। এরপর সেটি উপসচিব-যুগ্মসচিব-অতিরিক্ত সচিব হয়ে সচিব এবং মন্ত্রীদের কক্ষে পৌঁছায়। এই পুরো প্রক্রিয়াতে একটি স্ক্যান ফাইলের সঙ্গে একটি কাগজের ফাইল ঘোরে। বলা হচ্ছে ইফাইলিংয়ের সুবিধা অনেক কোন ফাইল কোথায় আছে চাইলেই বোঝা যায়। আবার একটি নির্দিষ্ট ফাইল নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কোন কর্মকর্তা ধরেও রাখতে পারেন না। কিন্তু যেহেতু অন্য দফতর থেকে আসা ফাইলগুলো সচিবালয়ে আসার পর স্ক্যান করে ইফাইলিংয়ের মর্যাদা দেয়া হয়। সেখানে মূল সময় অপচয় হয় শাখাগুলোতে। শাখাগুলোর কর্মকর্তারা সব ক্ষেত্রে ফাইল ছাড়তে দেরি করেন। তাদের কাছে ফাইলটি এলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও কেউ তা পালন করেন না। দেখা গেছে এই আধা ইফাইলিং করার ক্ষেত্রে আগ্রহ নেই বিদ্যুত বিভাগ এবং বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিগুলোর। সরকার ইফাইলিংয়ের মান নির্ধারণের জন্য যে মডেল তৈরি করেছে তাতে দুটির অবস্থা মোটামুটি। আরসবগুলোর অবস্থা নিম্নমানের। ইফাইলিংয়ের গ্রেডিং এর যে মান নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ফ্রন্টডেস্কের মাধ্যমে পাওয়া ফাইলের ৮০ ভাগ ইফাইলিং করাকে বলা হচ্ছে অসাধারণ, ক্রমান্বয়ে অতি উত্তম ৭০ ভাগ, উত্তম ৬০ ভাগ, চলতি মান ৫০ ভাগে আর চলতি মানের নিচে হলে ৫০ ভাগ। কোনক্রমে মোট প্রাপ্ত ফাইলের ৫০ ভাগ নথি নিষ্পতি হলে তাকে বলা হচ্ছে অসাধারণ আর অতিউত্তম ৪৫ ভাগ, উত্তম ৪০ ভাগ, চলতি মান ৩৫ ভাগে আর চলতি মানের নিচে হলে ৩০ ভাগ এছাড়াও ইফাইলিংয়ের মাধ্যমে পত্র জারি ৪০ ভাগ হলে বলা হচ্ছে অসাধারণ, অতিউত্তম ৩৫ ভাগ, উত্তম ৩০ ভাগ, চলতি মান ২৫ ভাগে আর চলতি মানের নিচে হলে ২০ ভাগ। এই লক্ষ্যটি এই অর্থ বছরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগের মধ্যে মোট পাওয়া ডাক থেকে নথি প্রস্তুত করেছে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান। এরা হচ্ছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৬৬ ভাগ, বিদ্যুত বিভাগ ৫৬ ভাগ এবং নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৪২ ভাগ। অন্যদের অবস্থা খুবই নাজুক। বিদ্যুত বিভাগের ইফাইলিংয়ের প্রতিবেদন বলছে আরইবি ২৭ ভাগ, পিডিবি ১০ ভাগ, বৈদ্যুতিক উপদেষ্টার দফতর ২৪ ভাগ, ওজোপাডিকো ২৫ ভাগ, পিজিসিবি ১৫ ভাগ, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ৩ দশমিক ১৪ ভাগ, ডিপিডিসি ২৫ ভাগ, নেসকো ৮ দশমিক ৩৬ ভাগ, বিআর পাওয়ার জোন ১ দশমিক ২৯ ভাগ, আরপিসিএল ৮ ভাগ, ইজিসিবি ৫ ভাগ, সেড্রা ২৬ ভাগ আর পাওয়ারসেল ১২ ভাগ নথিকে ইফাইলিংয়ের রূপান্তর করেছে। বিদ্যুত সচিব ড. আহমদ কায়কাউস সমন্বয় সভায় সম্প্রতি যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে দফতর, সংস্থা এবং কোম্পানিক প্রাপ্ত চিঠির ৮০ ভাগ ইফাইলিংয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন এবং পত্র জারি অব্যাহত রাখতে হবে। ডাক থেকে নোটশিট তৈরিতে ইফাইলিং পদ্ধতির হার বৃদ্ধি করতে হবে। এসব কার্যক্রমের পরিসংখ্যান প্রতিমাসের ৭ তারিখের মধ্যে বিদ্যুত বিভাগে পাঠাতে হবে। ওই বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে বিদ্যুত বিভাগকে পেপারলেস করতে হবে। তবে ইফাইলিংয়ের প্রতিবেদন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাচ্ছে না দিচ্ছে না কোম্পানি এবং সংস্থাগুলো। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের বিদ্যুত বিভাগ ইফাইলিং এ কাজ করছে। আমরা আগে কাগজ ব্যবহার করলেও এখন বিভিন্ন চিঠিপত্র ইফাইলিং এ সারছি। এতে করে সময় বেঁচে যাচ্ছে। কম ইফাইলিং হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাইরে থেকে যেসব ডাক আসে সব ইফাইলিং এ অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সেজন্যই বাস্তবায়নের হার কম।
×