ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনে পড়ে সুবীরদা

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৮ জুন ২০১৯

মনে পড়ে সুবীরদা

সুর সম্রাট সুবীর নন্দী গত ৭ মে ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। আর কোন দিন দেখা হবে না এই সাদা মনের মানুষটির সঙ্গে। মানুষ মরণশীল, একদিন আমাদের সবাইকে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু তারপরও সুবীরদার চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে বাংলার গানের ভুবন আরও সমৃদ্ধ হতো নি:সন্দেহে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেই সুযোগটা আমাদের দেননি, নিয়ে গেলেন না ফেরার দেশে। তার সঙ্গে সব শেষে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে তার ছোট ভাই ড. সুবিনয় নন্দীর নিউইয়র্কের বাসায় দেখা হয়েছিল। তার কথাবার্তায় মনে হয়েছিল তিনি যেন এক সাদা রক্তের মানুষ (এ মেন অব হোয়াইট ব্লাড)। নিউইয়র্ক পূজা সমিতি কর্তৃক সুবীর নন্দী স্মরণে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, অনেককেই বক্তৃতা দিতে এসে চোখের জল ফেলতে দেখেছি। একজন শিল্পীকে মানুষ যে এত ভালবাসে তা সুবীর নন্দীর স্মরণ সভায় দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি। সুবীর নন্দী ১৯৫৩ সালের ১৯ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তারা ৬ ভাই ও ৩ বোন। বড় ভাই বহু বছর পূর্বে প্রয়াত হয়েছেন। ভাইদের মধ্যে একজন কানাডা এবং বাকিরা আমেরিকায় প্রবাসী। তার স্ত্রী পুরবী নন্দী (জবা), একমাত্র কন্যা ফাল্গুনী নন্দী (মৌ)সহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব রেখে গেছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বানিয়াচং উপজেলার নন্দী পাড়া গ্রামে সুবীর নন্দীর পৈত্রিক বাড়িটি এখনও জবর দখল হয়ে আছে। এই বাড়িটি দখল মুক্ত করে, সরকার কর্তৃক বাড়িটিকে সংরক্ষণ করে তার উত্তরাধিকারীদের হাতে হস্তান্তর করলে সুবীর নন্দী ও তার সৃষ্টি স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। তার গাওয়া গানগুলোকে সংগ্রহ করে সুবীর নন্দীর নামে একটি আর্কাইভ তৈরি করলে সুবীর নন্দীর রেখে যাওয়া সুর ও ছন্দ যুগে যুগে বাঙালীর হৃদয় রাঙিয়ে তুলবে বাঙালিয়ানায়। সবার মুখে মুখে ধ্বনিত হবে, দিন যায় কথা থাকে, হাজার মনে কাছে প্রশ্ন রেখে, এক যে ছিল সোনার কন্যা, উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়ে যা- সহ অগন্তি গান। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে এই সুর সম্রাটের গানের ভুবন সম্পর্কে, যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের গান প্রিয় মানুষ জানতে পারবে বাংলা গানের এই কিংবদন্তিকে আর জানতে পারবে। তিনি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ভূষিত করেন। তিনি, শুভদা, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘের পরে মেঘ ও মহুয়া সুন্দরী চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে পাঁচবার এই পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার এ বছর তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ১৯৬৭ সালে প্রথম তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের শিক্ষক ছিলেন ওস্তাদ বাবর আলী খান ও বিজিত লাল দাশ। সুবীর নন্দী ঢাকায় আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম যে গানটি গান সেটি ছিল ‘যদি কেউ ধুপ জ্বেলে দেয়।’ ৫০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন তিন হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। তাছাড়া দেশে বিদেশে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে খোলা মঞ্চে অসংখ্য গান গেয়ে বাংলা আধুনিক গানের এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে গেলেন এই জনপ্রিয় সুর সম্রাট। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে সূর্যগ্রহণ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৮ সালে অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে চিত্র নায়ক রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৪ এপ্রিল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ৩০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ৫ ও ৬ মে পর পর দুই দিন হার্ট এ্যাটাকের পর তিনি ২০১৯ সালের ৭ মে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। বাংলা ও বাঙালী যত দিন বেঁচে থাকবে সুবীর নন্দী আমাদের মাঝে ততদিন বেঁচে থাকবেন। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হওয়া এই গুণী-শিল্পীকে জাতীয়ভাবে স্মরণ রাখার জন্য তার নামে ঢাকা-হবিগঞ্জ জাতীয় সড়কের নামকরণ ও তার নামে হবিগঞ্জে একটি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×