ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ উদদীনের চির বিদায়

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৮ জুন ২০১৯

 মমতাজ উদদীনের চির বিদায়

শিক্ষক, নাট্যব্যক্তিত্ব, লেখকই শুধু নন, সদা হাস্যোজ্জ্বল এমন রসিক শিল্পী তার কৃতী অধ্যায়কে পেছনে ফেলে চলে যান অন্য কোন জগতে। রেখে যান শুধু কীর্তিময় সমৃদ্ধ ভুবনই নয়-এক মানবিক, উদার, অমায়িক, দেশ প্রেমিক মানুষের চিরস্থায়ী চারিত্রিক শৌর্যের অনবদ্য জীবন গাথাও। সত্যিই বহুমাত্রিক সৃজন ক্ষমতার অধিকারী এই বিশিষ্ট প্রাজ্ঞজন শুধু ছাত্র তৈরি করার স্থপতিই ছিলেন না, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুদ্ধ শিল্পচর্চার একজন বিদগ্ধ নির্মাতাও ছিলেন। ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে শৈশব-কৈশোরের পাট চুকাতে হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার এক নিভৃত গ্রামীণ আবহে। পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ (সম্মান) থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে শিক্ষকতার পেশায় তার দক্ষ কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করেন। সে সময়ের ভারত উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির বলয় ছিল ব্রিটিশমুক্ত দেশের জন্য আত্মপরিচয়ের সূক্ষ্ম অনুসন্ধান। অতি বাল্যকাল থেকে তা অবলোকন করতে করতে উদীয়মান কিশোর মমতাজ উদদীন ’৪৭-এর দেশ বিভাগকে মানতে পারেননি। সেই বোধে শুধু ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলাই নয়, উদ্দীপ্ত চেতনায় ধারণ করলেন বাম রাজনৈতিক আদর্শের নীতি-নৈতিকতাও। সেই ১৭ বছরের কিশোর ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়ে তার রাজনৈতিক সচেতনতাকে আদর্শিক বোধে চালিত করলেন। আর সেখানেই প্রচ্ছন্ন ছিল সদ্য দেশ ভাগ হওয়ার একটি পরাধীন ভূমিতে এক স্বাধীনচেতা জ্ঞান সাধকের শৈল্পিক সুষমার নিরন্তর অভিযাত্রা। সেই সমৃদ্ধ মননশীলতায় জীবনভর তাড়িত হয়েছেন। সাদামাটা জীবনের বিত্ত বৈভবের জায়গা ছিল অতি সামান্যই। ১৯৬৪ সালে সরকারী চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবনকে নানামাত্রিকে পরিশীলিত করেছেন। রবীন্দ্র ভক্ত এই চিন্তাশীল নাট্যজন শ্রেণীকক্ষে শুধু নির্দিষ্ট পাঠদানেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতেন না, অবধারিত মননশৈলীতে স্থান করে নিত বাংলা সাহিত্যের, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বলয়। সঙ্গত কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ক্লাসে পাঠদানকালে বিশিষ্ট পর্যায়ে সমুজ্জ্বল থাকতেন। পরবর্তীকালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতার বর্ণাঢ্য জীবনকে সম্প্রসারিত করেছেন। জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত এই গুণীজন নাট্যকলাকে যে মাত্রায় তার মননসাধনার অনুষঙ্গ করেছেন তা সত্যিই অনুপম। নাটক শুধু মঞ্চস্থ করেই দায়মুক্ত হননি কখনও, অভিনয় শিল্পেও পারদর্শিতা দেখিয়ে দর্শকদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে তার শৈল্পিক শক্তির কোন তুলনা নেই। যুগ ও সময়ের আবেদনে ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে যে শিল্পী তার কালকে অতিক্রম করে যান তিনি শুধু পুরস্কার কিংবা সম্মাননার প্রত্যাশী থাকেন না। তবুও সময়ের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার পুরস্কারই তাকে সাদর সম্ভাষণ জানায়। সেভাবে সদ্য প্রয়াত এমন গুণী ব্যক্তিত্ব একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ সম্মাননায় অভিষিক্ত হন। তার গুণগ্রাহী, সুহৃদ এবং অসংখ্য নিকটজন তাকে স্মরণ করতে গিয়ে এই শিল্পীর কীর্তির চেয়েও মানুষ হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ, হাস্যরসে ভরপুর কৌতুক প্রিয়তাকেই বিশেষভাবে মনে করেছেন। এর চেয়ে বড় পুরস্কার একজন জননন্দিত শিল্পীর জন্য অন্য কিছু হতেই পারে না। এই বছরের ১৮ জানুয়ারি শেষ জন্মদিনে এই দ্যুতি ছড়ানো শৈল্পিক মনন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন আমার সময় শেষ হয়ে আসছে- আমাকে যেতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণ ও শ্বাসকষ্টে শেষ সময়টুকু অস্বস্তিতে কাটিয়েছেন। এখন যেখানে গেছেন সবাইকে ছেড়ে সেখানে তার আত্মা শান্তিতে কাটাক- এমন প্রার্থনা বিশ্ব নিয়ন্তার কাছে। স্বল্প সংখ্যক কৃতী মানুষের শূন্যস্থান কখনও পূরণ হয় না। মমতাজ স্যারেরও মূল্যবান জায়গাটি খালিই পড়ে থাকবে। তবে তার রেখে যাওয়া শৈল্পিক পথযাত্রার সমৃদ্ধ পরিক্রমা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে যাবে- এমন ধারণা অমূলক নয়।
×