ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিলোনিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধ ॥ ৪ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৪ জুন ২০১৯

 বিলোনিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধ ॥ ৪ মে, ১৯৭১

এই দিন চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানি দুই প্লাটুন যোদ্ধা শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানে গোপন পথে এগিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ১৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। এতে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিলোনিয়ায় অবস্থান ও বিলোনিয়ার সর্বশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত হয় এবং বন্দুয়া-দৌলতপুর রেললাইন ও ছাগলনাইয়া থেকে উত্তর দিকে চলে যাওয়া রাস্তা বরাবর দুটি অক্ষে অগ্রসর হয়ে এক আকস্মিক আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। পাকবাহিনী অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর ভারি মেশিনগান এবং প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত অন্যান্য অস্ত্রের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আসা অবিরত গোলাগুলির কবলে পড়ে প্রায় ৭০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এতে শত্রুরা সহজেই বুঝতে পারে যে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানটি দুর্বল নয়। বরং এই ব্যাটালিয়ন নিয়মিত ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা- সংবলিত একটি সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় ঘাঁটিতে ফিরে আসে। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার রাজপুরে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ৬ জন সৈন্য নিহত ও ৩ জন আহত হয়। পিরোজপুরে পাক বর্বরবাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুককে ধরে এনে অমানুষিক অত্যাচার চালায়। নির্মম অত্যাচারে ওমর ফারুক শহীদ হন। ঝালকাঠিতে পাকহানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সাহায্যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকবর্বরদের পৈশাচিক নির্যাতনে পাঁজি পুঁথিপাড়া এলাকার অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের বিশেষ দূত ইসমত কিতানী রাওয়াল পিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশের দলত্যাগী সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকম-লীর পক্ষ থেকে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আমাদের প্রিয় ভূমি পাকিস্তানকে খন্ড করার অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা করছি। রাজনৈতিক চরমপন্থীদের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় আমরা দুঃখ পেয়েছি ও হতাশ হয়েছি। বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের নেতা বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো দেশব্যাপী দীর্ঘ ১৭ দিনের সফর শেষে বলেন, ‘পাঁচ লাখ বৌদ্ধের প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তান। চিরদিন পাকিস্তান বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান হয়েই থাকবে। বৌদ্ধরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশকে দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবে।’ ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাক সেনাবাহিনী নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামে হানা দিয়ে চার শতাধিক বাঙালীকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়াই ছিল নিরস্ত্র গ্রামবাসীর অপরাধ। নাটোরের ছাতনী গ্রাম গভীর ঘুমে নিমগ্ন গ্রামবাসী! মধ্যরাতে ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে হানা দেয় পাকবাহিনী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে ছাতনী স্লুইস গেটে এনে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার পর লাশগুলো এসিডে ঝলসে দেয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ইউএনআই এর বরাতে ’কমান্ডো আক্রমণে পাকসৈন্য মরছে’ ‘শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বিভিন্ন স্থানে পাকসৈন্যের ওপর মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণ আবার জোরদার হয়ে উঠেছে। গজারিয়া, চাঁদহাট, রাজানগর ও ফরিদপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের আক্রমণে পাকসৈন্য নাজেহাল হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। কোচবিহারের বিপরীত দিকে অবস্থিত ভূরুঙ্গামারী চৌকি থেকে পাকসৈন্যদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে। চিলহাটি ও ডোমারের মধ্যবর্তী তিস্তাসেতু এবং কাকিনা ও ভূষিরবন্দরের মধ্যবর্তী সানিয়াজানা সেতুকে মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা কাকিনাতে আটক হয়ে পড়েছে। তাদের লালমনিরহাটে ফিরে যাবার পথ নেই। দিনাজপুরের জগদলে গেরিলা বাহিনী পাকসৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। প্রচুর পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। মুক্তিফৌজ ঠাকুরগাঁয়ের একটি বিদ্যুত কেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়েছে। রংপুরজেলার ডিমলা ও বাউরাতে মুসলিম লীগের সাতজন পাকিস্তানী গুপ্তচরকে মুক্তিফৌজ খতম করেন। গত সপ্তাহে মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণে ফেনী এলাকায় চারজন অফিসারসহ শতাধিক পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও জগ্ননাথদীঘির মধ্যবর্তী কোন একস্থানে সোমবার মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যের একটি জীপের ওপর আক্রমণ চালায়। বিধ্বস্ত জীপের ৪ জন আরোহী নিহত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×