ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে সবাই ছুটছেন গহনা কিনতে

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২ জুন ২০১৯

 পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে সবাই ছুটছেন গহনা কিনতে

ওয়াজেদ হীরা ॥ রমজান প্রায় শেষের পথে। হাতেগোনা ক’দিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ আনন্দে যোগান দিতে কেনাকাটার যুদ্ধে ক্লান্তিহীন ছুটছেন নগরবাসী। এখন নতুন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে গহনা কিনতে সবাই ছুটছেন গহনা ও প্রসাধনীর দোকানে। কেউ নিজের জন্য, আবার কেউ উপহার দেয়ার জন্য গহনা কিনছেন। নতুন ডিজাইনের পুঁতি, কড়ি, শেল, সুতা, কাঠ ও পিতলের তৈরি গহনার প্রতিই তরুণীরা বেশি আগ্রহী। এবার ফ্যাশন ডিজাইনাররা তাদের হাউসগুলোতে কাঠ, পিতল, চুমকির ব্যবহারে বিভিন্ন মোটিভের গহনা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তবে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের বেশি আগ্রহ ডায়ম-ের গহনায়। এছাড়া রূপার ওপর সোনার প্রলেপ দেয়া গহনা ও ইমিটেশনের গহনায়ও চাহিদা মেটাচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। রাত দিন সমানতালে আলোকিত অলঙ্কারের দোকানগুলো। রাজধানীর চাঁদনি চক, নিউমার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি ও বায়তুল মোকাররম মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, গহনার দোকানগুলোতে বেশ ভিড়। শপিংমলগুলোতে গহনার দাম নির্ধারিত থাকলেও ছোট দোকানগুলোতে তা থাকে না এবং এসব দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ও বেশি। ঈদের আনন্দে নিজেকে সাজাতে গহনার বাজারেও ভিড় করেছেন ক্রেতারা। ঈদ কেন্দ্র করে পোশাক, জুতা, কেনা হলেও ম্যাচিং করে গহনা কেনা হয়নি শনিরআখড়ার বাসিন্দা পারভীন আক্তার লাকীর। নিজের ও তার দুই মেয়ের জন্য কিনবেন রঙিন চুড়ি। তাই গহনা কিনতে এসেছেন গাউছিয়ায়। গাউছিয়ায় পোশাকের মার্কেটের পাশাপাশি গহনার বাজারেও অনেক ভিড়। এই ভিড় ঠেলেই তিনি গহনার শোরুমে এসেছেন। ম্যাচিং করে কিনেছেন চুরি ও পিতলের মধ্যে ছোট ছোট পাথরের কাজ করা গহনা। তিনি জানান, এবার নতুন নতুন ডিজাইনের গহনা এসেছে। দোকানিরা এগুলো ইন্ডিয়ান বলে দাম হাঁকাচ্ছেন অনেক বেশি। কিন্তু দরদাম করে অনেক কমে কেনা যায়। আরেকজন ক্রেতা লায়লা আক্তার জানান, নিজের জন্য কিনেছি। এখন বান্ধবীর জন্য গহনা খুঁজছি। গিফট করব। দাম যা বলেছে। তাতেই কিনেছি। এদিকে, গহনা ও চুড়ির পাইকারি মার্কেটের বিক্রেতারা জানান, রোজা শুরুর পর থেকেই গহনা ও চুড়ির মার্কেটে খুচরা বিক্রেতার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। নিত্যদিনের মতো চকবাজারে পা ফেলার জায়গাও ছিল না। চাহিদা অনুযায়ী চুড়ির প্রত্যেকটি দোকানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বিক্রি হয়েছে বলে জানান পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। চকবাজারের কুমকুম ফ্যাশন চুড়ি হাউসের স্বত্বাধিকারী বশির উদ্দিন জানান, ঈদে ভারতের টিভি সিরিয়ালের চরিত্রের নামে বেশ কয়েক ডিজাইনের চুড়ি বাজারে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাখি, রেশমি, ঝুনঝুনি বেশ জনপ্রিয়। রোজার পর থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ চার লাখ টাকার চুড়ি বিক্রি হয়েছে। আরেক বিক্রেতা জরি মহলের স্বত্বাধিকারী আবদুর রহমান বলেন, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী খুচরা দোকানিরা চকবাজার থেকে পাইকারি পণ্য কিনে থাকেন। অভিজাত পোশাক প্রতিষ্ঠান আড়ং, কে ক্রাফট, অঞ্চনস, ওজি, রং, দেশাল, নাগরদোলা প্রভৃতি দোকানেও গহনার বিক্রি বেশ ভাল। আজিজ সুপার মার্কেটের দেশাল আউটলেটের বিক্রয়কর্মী রোমিও বলেন, এবার ঈদে পোড়া মাটির ওপর পাথর ও চুমকি বসানো গহনা এসেছে। এ ছাড়া বৈচিত্র্য আনতে পুঁতির সঙ্গে ধাতু, শেল বা সুতার মিশ্রণে গহনার নক্সা বানিয়েছি। এখানে কানের দুল হচ্ছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত, ব্রেসলেট ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। মৌচার মার্কেটের ভেতরের দোকানের চেয়ে সরু গলির দোকানগুলোতে ভিড় বেশি। নানা রঙের আলোয় জ্বলমল করছিল দোকানের বিভিন্ন গহনা। এছাড়াও আলোর কারণে পাথরের গহনাগুলো চিকমিক করছিল। আফরিন জামান পাথরের কানের টপস কিনেন। তিনি বলেন, এবারও পাথরের মধ্যে অনেক অলঙ্কার এসেছে। এসব জায়গায় দামাদামি না করে কিনলেই ঠকে যাবেন। এদিকে তখনো পছন্দে ম্যাচিং গহনা পাচ্ছিল না আরেক ক্রেতা জেসমিন জেরি। তিনি জামা হাতে দোকানে দোকনে ঘুরে ফিরছেন। এদিকে, রাজধানী অধিকাংশ মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, সোনার গহনার দাম মধ্যবিত্তের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বর্তমানে রূপার ওপর সোনার প্রলেপ দেয়া গহনা বেশি কিনছেন মধ্যবিত্ত নারীরা। এসব দোকানে তাই ভিড়ও বেশি। মৌচাক মার্কেটে রূপার ওপর সোনার প্রলেপ দেয়া গয়না বানাতে এসেছেন মুনিরা ইসলাম। তিনি বলেন, স্বর্ণের গয়না তো আছেই কিন্তু সেটা থাকা আর না থাকা সমান। কেননা এসব গয়না পরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। তাই এবার একসেট রূপার গয়না বানাতে এসেছি। নিউমার্কেট গাউসিয়া ও চাঁদনি চক মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে পাথরের সেটগুলো ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, কুন্দন সেট ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা, এডি (পাথর) সেট ৩ হাজার ৫০০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইমিটেশনের মালার সেট সাড়ে ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, কানের দুল ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, চুড়ি ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, হাতের ব্রেসলেট ৭০ টাকা থেকে সাড়ে ৮০০ টাকা, আংটি ১০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ঈদের কেনাকাটায় স্বর্ণ কিংবা রূপার মধ্যে সন্তুষ্ট থাকলেও উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের বেশি আগ্রহ ডায়মন্ডের গহনায়। আল হাসান ডায়মন্ড গ্যালারি, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, অলংকার নিকেতন, ভেনাস ডায়মন্ড কালেকশন, আফতাব জুয়েলার্স, ডায়মন্ড গার্ডেন, ডায়মন্ড হ্যাভেন, সঙ্গিনী ডায়মন্ডসহ প্রতিটি শোরুমে শোভা পাচ্ছে হীরার গহনা। এসব শোরুমে ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। উচ্চবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্তদের মধ্যেও কেউ কেউ হীরার গহনা কিনছেন। বসুন্ধরার ডায়মন্ড গার্ডেন, গুলশানের ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, বেইলি রোডের ডায়মন্ড গ্যালারি ঘুরে দেখা যায় মানভেদে এক ক্যারেট মানের বোম্বে কাট হীরার দাম ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। আর একই মানের বেলজিয়াম কাট হীরার দাম ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। ডায়মন্ডের কানের দুলের দাম পড়বে ১৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা, নাকফুল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৭ হাজার ২০০ টাকা, আংটির দাম পড়বে সাড়ে ১১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা, লকেট ৭ হাজার থেকে ৫০ হাজার, ব্রেসলেটের দাম ৮৪ হাজার থেকে ৯৮ হাজার টাকা। এছাড়া হীরার গলার সেটের দাম পড়বে ৬০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব হীরের শোরুমগুলোতে নানা অফারও চলছে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের নিচ তলায় দেশের স্বর্ণের গয়নার অন্যতম বৃহৎ মার্কেট। নামীদামী সব ব্র্যান্ডের জুয়েলারি দোকান রয়েছে এখানে। ঈদ উপলক্ষে শো-রুমগুলোতে বিভিন্ন ডিজাইনের গহনাসহ স্বর্ণের চুড়ি, কানের দুল, চেন, আংটিসহ বাহারি সব স্বর্ণালঙ্কার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানকার এক বিক্রয়কর্মী বলেন, নতুন নতুন ডিজাইনের গহনায় ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। কেউ কেউ আগের ডিজাইন পরিবর্তন করতেও আসছে। তবে এর সংখ্যা খুবই কম বলে জানান তিনি। আমিন জুয়েলার্সের বায়তুল মোকাররম মার্কেটের শো-রুম ম্যানেজার জিল্লুুর রাহমান মনে করেন, বিক্রি হচ্ছে তবে গত বছরের মতো নয়। উৎসবে স্বর্ণ অনেক কমে কেনাকাটা গেছে বলে মনে করেন তিনি। আরও কয়েকটি শোরুমের দায়িত্বরতরাও জানালেন একই সুর। আলভী জুয়েলার্সের বিক্রয় কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণের ব্যবসার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপই বলব। মানুষ স্বর্ণের গয়না বেশি কিনে বিয়ের সময়। সাধারণত দেশে ঈদের পর বিয়ে অনুষ্ঠান বেশি হয়। তাই ঈদের আগে বেশি হয় স্বর্ণের ব্যবসা। কিন্তু এ বছর তেমন কোন ব্যবসা নেই। তবে যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই আগ্রহ নতুনত্ব নিয়ে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি নির্ধারণ করা দাম অনুযায়ী, প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ভাল মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা। ২১ ক্যারেট ৪৭ হাজার ৮২২ টাকা এবং ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ৪২ হাজার ৮০৭ টাকা। এদিকে, ঈদের পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়েরা কিনছেন লিপস্টিক, নেইলপলিশ, আইশ্যাডো, আইলাইনার, মেকআপ বক্স ইত্যাদি। এর পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে ফাউন্ডেশন, প্যান কেক, বডি স্প্রে, পারফিউম, প্যানস্টিক ইত্যাদি। দেশী-বিদেশী সব ধরনের কোম্পানির পণ্যই বাজারে রয়েছে। লিপস্টিক ও নেইলপলিশ বেশি বিক্রি হচ্ছে জর্ডানা, লরিয়াল, জ্যাকলিন, র‌্যাভলন, মেবেলিন ইত্যাদি কোম্পানির। পারফিউম পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানিভেদে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়, বডি স্প্রে ২০০ থেকে ৫০০, মেকআপ ও ফেস মেকআপ ৩০০ থেকে ৩ হাজার, আইলাইনার ৫০ থেকে ৩০০, আইশ্যাডো ৩০ থেকে ২০০, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লিপস্টিক ১৫০ থেকে ৪০০, কাজল ৫০ থেকে ৩০০, গ্লিটার ৫০, আলতা ৪০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। বিক্রেতারা জানালেন, পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন উজ্জ্বল শেড যেমন : লাল, গোলাপী ইত্যাদি রঙের লিপস্টিক চলছে বাজারে বেশ। নেইলপলিশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রাজধানীর মার্কেটগুলোর মতোই বিক্রি হচ্ছে ফুটপাথে। তবে ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে কম মূল্যের বিভিন্ন প্রসাধনী। সাধ্যমতো স্ব স্ব অবস্থান বুঝে সাধ্য অনুযায়ী শপিং করছেন ক্রেতারা।
×