ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি জোটে নড়বড়ে অবস্থা

প্রকাশিত: ১০:২২, ২ জুন ২০১৯

 বিএনপি জোটে নড়বড়ে অবস্থা

শরীফুল ইসলাম ॥ শত চেষ্টা করেও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ২০ দলীয় জোটে ফেরাতে পারেনি বিএনপি। কর্নেল (অব) অলি আহমেদের দল এলডিপিও যে কোন সময় জোট ত্যাগের ঘোষণা দিতে পারে। এ ছাড়া বিএনপির অপর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও চলছে অস্থিরতা। এ জোটের শরিক দল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দূরে সরে আছে। আরেক শরিক দল গণফোরাম নেতা মোস্তাফা মোহসিন মন্টু নতুন দল করার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি জোটের এখন নড়বড়ে অবস্থা। খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করতে গিয়ে বার বার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে এই অস্থিরতার ঢেউ লাগে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও। বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্য শরিক দলকে গুরুত্ব না দেয়ায় সৃষ্টি হয় ক্ষোভ-বিক্ষোভ। কিন্তু তা নিরসনে কার্যকর তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোটকে অন্ধকারে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপকালে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চারটি দলের নেতাদের সঙ্গে নেয়া এবং সারাদেশের ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির সময় এ বিরোধ আরও বাড়ে। কারণ, ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলকেই আশানুরূপ আসন দেয়া হয়নি। সর্বশেষ জোটের কাউকে কিছু না বলে বিএনপি দলীয় ৫ সাংসদের জাতীয় সংসদে যোগদানকে কেন্দ্র করে বিএনপির প্রতি ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের বিরোধ ও অস্থিরতা তুঙ্গে ওঠে। এ অবস্থায় আগেই এ জোটে ভাঙ্গনের আশঙ্কা করেন অভিজ্ঞ মহল। আর এ আশঙ্কা সত্যি হয় ২০ দলীয় জোটের পুরনো ও পরীক্ষিত শরিক দল বিজেপির জোট ছাড়ার মধ্য দিয়ে। এদিকে তারেক রহমান একক সিদ্ধান্তে দলীয় ৫ এমপিকে সংসদে পাঠানোর কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও ক্ষুব্ধ হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এনডিপি। যদিও কিছু ডামি নেতাকে ওই ৩ দলের নতুন কমিটি করে জোটে ২০ দলের সংখ্যা ঠিক রাখে বিএনপি। এর পাশাপাশি নির্বাচনের আগেই জোটে আরও তিনটি ছোট দল ভিড়িয়ে ২৩ দল বিশিষ্ট ২০ দলীয় জোট করা হয়। এর ফলে বিজেপি চলে যাওয়ার পরও এ জোটে এখন দলের সংখ্যা ২২। যদিও বিএনপি ছাড়া এ জোটের অন্য কোন দলের তেমন অস্তিত্ব নেই। এ জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়ে আগে থেকেই ছন্ন ছাড়া। আর ২০ দলীয় জোট হওয়ার আগে পুরনো ৪ দলীয় জোটের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটও অনেক আগেই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছেন। যদিও ডামি নেতা দিয়ে জোটে এ দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নেতা এখন এ জোটের কোন কর্মকা-ে অংশ নিচ্ছে না। আর এ জোটের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম নেতা মোস্তফা মোহসিন মন্টু এখন নতুন দল করার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি গণফোরামের ইফতার পার্টির দিন তিনি পৃথক ভেন্যুতে ইফতার পার্টির আয়োজন করে নতুন দল গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। এদিকে এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকায় দল ও জোটের নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। তাই তিনি বিএনপি ও জোটের নেতৃত্ব দিতে চান। তিনি বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চরম ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে অবিলম্বে তাকে দায়িত্ব দেয়ার আহ্বান জানান। তার এ আহ্বানের পর বিএনপির লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের কিছু সিনিয়র নেতা চরম ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এলডিপির টানাপোড়েন চলছে বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে যে কোন সময় কর্নেল অলির দল এলডিপিও বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। জোটগতভাবে নির্বাচন করে বিপুলভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি জোট। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ৪ দলীয় জোটগতভাবেই নির্বাচন করে বিএনপি। এ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপি জোটের। ২০১২ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে ৪ দলের সঙ্গে আরও ছোট ছোট ১৬ দল নিয়ে ২০ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। কিন্তু জোটের পরিধি বৃদ্ধি করেও রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয়নি তারা। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজপথের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জোট। বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। আর ক্ষমতা থেকে দূরে সরে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। ২০১৫ সালে টানা ৯২ দিন লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালন করে বিএনপি। এ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে সহিংস কর্মকা-ে জড়িয়ে দেশ-বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে চরম সঙ্কটের মুখে পড়ে দলটি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই তাদের দলে সঙ্কট চলছে জানিয়ে এ সঙ্কট মোকাবেলায় দলের নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, দলের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করে তাঁকে মুক্ত করতে হবে। তাহলেই বিএনপি সঙ্কটমুক্ত হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ মাস আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর পর নেতৃত্ব সঙ্কটের কারণে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এক পর্যায়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ জোটের অধীনেই নির্বাচন করে বিএনপি। কিন্তু এ জোটের কর্মকা-ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর গুরুত্ব না থাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব দলের নেতাকর্মীরা গাছাড়া ভাব প্রদর্শন করে। এ ছাড়া মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে অনেক ত্যাগী নেতা মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এর ফলে বিএনপি জোট শোচনীয়ভাবে নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোটের নেতারা বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকায় বিএনপি জোটে অস্থিরতা দেখা দেয়। ২০ দলীয় জোটের কোন কোন শরিক দল বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানায়। সর্বশেষ বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ এমপির মধ্যে ৫ এমপির সংসদে যোগদানকে কেন্দ্র করে বিএনপি জোটের অস্থিরতা আরও বাড়ে। এর ফলে বিএনপি জোটে এখন নড়বড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনীতিতে সব সময় সমান যায় না। কখনও ভাল, কখনও মন্দ এভাবেই এগিয়ে যেতে হয়। বিএনপি এখন নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। তাই বিএনপি জোটের রাজনীতিও সমস্যার সম্মুখীন। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে দল ও জোটের স্বার্থে কাজ করলে এ সমস্যা হয়ত একদিন থাকবে না।
×