ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২ জুন, ১৯৭১

সমঝোতার কোন অবকাশ নেই!

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২ জুন ২০১৯

  সমঝোতার কোন অবকাশ নেই!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২ জুন দিনটি ছিল বুধবার। এদিন পূর্ব বাংলা ট্র্যাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী ব্রিটেনের শ্রমিক দলের এমপি মিঃ মাইকেল বার্নস এবং ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ সভাপতি ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিশ্বকে অবশ্যই এই দুঃখজনক ঘটনাটির একটি সমাধান খুঁজতে হবে।’ তিনি পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে সেটাকে শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলাকে অর্থহীন বলেছেন। তিনি এবং তার সরকার এই ব্যাপারটিকে জাতিসংঘের সামনে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে অল-ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের জনগণ যে কোন মূল্যে এর স্বাধীন অস্তিত্বকে রক্ষা করবে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্ববাসীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, পাকিস্তানী কাঠামো থেকে আমাদের মাতৃভূমিকে পৃথক করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি। এই কাঠামোর অধীনে আপোস করার কোন অবকাশ নেই। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তাঞ্চলে স্থানীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, আমরা বাংলাদেশের ইস্যুর রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য কোন মধ্যস্থতা চাই না। হাজার হাজার নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যাকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসার কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। এদিন পাকসেনারা পিরোজপুরের পেয়ারা বাগান এলাকা ঘেরাও করে। এদিন পোপ ষষ্ঠ পল এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ভাগ্যাহত মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিন ফনী মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দল নয়াদিল্লীতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করেন। বেগম নূর জাহান মোর্শেদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বাংলাদেশী আইন প্রণেতারা গতকাল ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানান ৪৫ মিনিট ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরতায় ভারতে যে সব বাংলাদেশী উদ্বাস্তু অবস্থান করছে, এই সম্পর্কিত সমস্যা প্রাধান্য পায়। এদিন ইউএনআইয়ের বরাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা শিরোনামে অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিফৌজ গেরিলা বাহিনী শ্রীহট্ট সেক্টরের তেলিয়াপাড়া ও আখাউড়ার মধ্যে সংযোগকারী রেল সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। কুমিল্লা সেক্টরে গেরিলাবাহিনী রেল ইঞ্জিন ও ওয়াগনকে লাইনচ্যুত করে দিতে সক্ষম হয় বলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়। ময়মনসিংহ সেক্টরে গেরিলা বাহিনী পাকফৌজের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ৭ জন পাকসৈন্যকে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রেফতার করে। সেনা ঘাঁটির পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে গেরিলারা সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পূর্ব বাংলা ট্র্যাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী ব্রিটেনের শ্রমিক দলের এমপি মিঃ মাইকেল বার্নস এবং ‘ওয়ান অন ওয়ান্ট’ সভাপতি ডোনাল্ড চেসওয়ার্থের বিবৃতি প্রকাশ করেন। এই দিন দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনেশ সিং এর ’বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে আসুন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বলা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আলোচিত হবে। ভারত, পাকিস্তান এমনকি সিলনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহ লক্ষ্য করলে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকে না যে মানুষের সম্পূর্ণ সমর্থন গণতন্ত্র, পরিবর্তন এবং স্থিতিশীলতার পক্ষে। এমনকি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের মাঝেও তারা তাদের রাজনৈতিক দল ও নেতা নির্বাচনের সময় নির্ভুলভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে তারা তাদের সমাজে আনতে চায় ব্যাপক কিন্তু শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন এবং যারাই তাদের এ আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। যখন মনে হচ্ছিল যে সিলন সরকার তাদের জনগণের মতামত প্রকাশের অধিকারকে রুখে দিতে চাইছে, তখনও ভারত সরকার এ প্রেক্ষাপটের বিপক্ষে তাদের সমর্থন করেনি। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে পাকিস্তানেও যখন একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, ভারত সরকার পুনরায় একই অবস্থান নেবে। বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা ও সমর্থন দেওয়ার আমাদের যে সংসদীয় অঙ্গীকার এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করেই নেওয়া হয়েছে। গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে সমর্থন দিতেই হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে এর কোনই বিকল্প নেই। ২৪ মে, লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে বক্তৃতা দিয়েছেন তা আর কিছুই না বরং এই সংসদীয় অঙ্গীকারেরই ধারাবাহিকতা এবং একে আমাদের স্বাগত জানানো প্রয়োজন। ...গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন এটি। সামরিক প্রশাসনের অধীনে কিছুদিন আগে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্বে ১৬৯ এবং পশ্চিমে ১৪৪, জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ আসনের এ নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমান ও তার পার্টি মোট ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। ... আমাদের সমর্থন জনগণের এই গণঅভ্যুত্থানের প্রতিই আছে, আমরা কোন বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করছি না, যদিও পাকিস্তান সরকার আমাদের তাই বলেই দায়ী করে থাকে। যদি প্রশ্ন আসে, আমরা কাকে সমর্থন করব, তবে আমরা পাকিস্তান সরকারের তৈরি করতে চাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদকে নয় বরং পাকিস্তানের মানুষের একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের অভ্যুত্থানকেই সমর্থন করব। আমরা এভাবেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি পালন করে এসেছি। ... স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শ কখনই এভাবে একই বিন্দুতে মিলিত হয়নি, যেমনটি এখন বাংলাদেশের সঙ্গে একিভুত হচ্ছে। আমাদের কাছেই এখন সব শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এই মুহূর্তে সংখ্যাটি ৪০ লাখ। কাল হয়তো ৭০ লাখ হবে এবং পরশু হয়তো সংখ্যাটি ১ কোটিতে গড়াবে। কেউ জানে না কত মানুষ আসবে, তাদের ভরণপোষণে আমাদের কত ব্যয় হবে এবং সেটা কতদিনের জন্য। .... বাংলাদেশ আজকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু, মানবাধিকারকে উড়িয়ে দিয়ে ঘটমান একটি জেনোসাইড আর প্রতিবেশীর সীমান্তে বিঘ্ন সৃষ্টির ইস্যু। আমরা এমনিতেই কল্পনার রাজ্যে মগ্ন থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম তিন সপ্তাহ মিস করে গেছি। আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল যে পাকিস্তানের এ নিপীড়ন ভারতে শরণার্থীদের বন্যা বইয়ে দিবে। যদি আমরা মুক্তিবাহিনীকে একই স্থানে সম্মিলিত করতে সাহায্য করতে পারতাম, তবে হয়ত শরণার্থীদের ভারতে আসতে হতো না। আর যদি তাড়া আসতও, পরবর্তীতে তাদের স্বাধীন এলাকাগুলোতে পাঠানো যেত। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য পেলে, পাকিস্তান সরকার বিষয়টি মীমাংসা করার চাপে থাকত। কিন্তু চাপ আজকে আমাদের ওপর। কারণ পাকিস্তানে কোন শরণার্থী নেই। কবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে, তা সরকারই ঠিক করবে। নিশ্চয়ই, এ ধরনের স্বীকৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে আরও শক্ত করে, এবং এখানে কোন আইনগত বা সাংবিধানিক বাধা নেই। ভবিষ্যতে কি করা হবে, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। যদি মুক্তিবাহিনী বাস্তবিকভাবেই একটি নির্দিষ্ট এলাকা পাকিস্তানী আর্মিদের কাছ থেকে রক্ষা করে রাখতে পারে, তবে সেখানে শরণার্থীদের সরিয়ে না যেতে পারে। বিকল্প উপায়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চেষ্টায় এই শরণার্থীদের ফিরতে বাধ্য করা যেতে পারে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা কখনই যেতে চাইবে না। তাদের পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে নিরাপত্তা প্রদান করতেই হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিটিতে প্রতিটি পদক্ষেপ ইতিবাচক হতে হবে। আমরা অর্থসাহায্য চাইতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেলের প্রতিক্রিয়া আমাদের হতাশ করছে।... আমাদের কখনই এমনটি হতে দেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজন পড়লে আন্তর্জাতিক কোন কার্যালয়ে, বাংলাদেশের সরকার ও পাকিস্তানের সামরিক সরকার আলোচনায় বসে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারে।.... এই মুহূর্তে পাকিস্তানের এ মিথ্যার পাহার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে আমাদের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের বিষয়ে অবশ্যই দ্রুত সারা পৃথিবীকে এগিয়ে আনতে হবে। যতই সময় লাগুক না কেন, হতে পারে কিছু সপ্তাহ, বা কিছু মাস কিংবা বছর, পাকিস্তানের মানুষের অবশ্যই অধিকার আছে, সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার এবং বাংলাদেশের মানুষকে অবশ্যই তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে, কিংবা অন্য কোন মীমাংসা করতে হবে। আমরা তাদের সফলতা কামনা করি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×