ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈরী হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২ জুন ২০১৯

  বৈরী হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ

পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রসহ জাতিসংঘ যখন বলছে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে সকলের যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া খুবই জরুরী। তা না হলে মানব জাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হতে পারে। সেই লক্ষ্যে আমাদের দেশের সরকার জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন- যা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কিন্তু সিলেট বন বিভাগের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর ফরেস্ট বিট এবং ওই রেঞ্জের কুরমাঘাট ফরেস্ট বিট থেকে রাতের আঁধারে বাঁশ পাচার হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে, যাদের মূল কাজ হচ্ছে বন পাহারা দেয়া, নতুন বনায়ন সৃষ্টি করা, বাস্তবে তাদের সহায়তায় বনের মূল্যবান বাঁশ পাচার হচ্ছে। এই রাজকান্দি ফরেস্ট বৃহত্তর সিলেটের একমাত্র ফরেস্ট এখন ও বিভিন্ন প্রজাতির বনজ সম্পদে ভরপুর কিন্তু সংঘবদ্ধ গাছ চোরেরা বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার সহযোগিতায় এই পাহাড়কে বৃক্ষশূন্য করছে। বলা হচ্ছে এসবে বেশির ভাগই প্রাথমিকভাবে আশপাশের করাত কলগুলোতে নেয়া হয়। এর আশপাশের উপজেলাগুলোতে অনেক করাতকল আছে যেগুলোর অধিকাংশ লাউয়াছড়া, রাজকান্দি ফরেস্টের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফরেস্ট আইনে আছে সরকার অনুমোদিত ফরেস্টের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল বসানো সম্পূর্ণ বেআইনী। কিন্তু বন আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবৈধ করাতকল স্থাপন করে গাছ চোরদের কাছ থেকে কমদামে গাছ ক্রয় করে বেশি দামে দেশের বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করে থাকে। কথিত আছে যে, চা বাগান থেকে ছায়া বৃক্ষ চুরি করে এসব করাতকলে বিক্রি করে। জানা যায়, বন বিভাগে দুইটি শাখা আছে একটি হলো বন বিভাগ (টেরিটরি) আর আরেকটি হলো বন বিভাগ (বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ), তাদের ঢাকা থেকে মাঠপর্যায়ে জনবলের সংখ্যা ও মূল বিভাগের মতো। তাছাড়া বন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় যা চট্টগ্রামে অবস্থিত, সেখানেও অনেক কর্মকর্তা কর্মরত। লাউয়াছড়া ফরেস্ট বাংলার কাছে একটি ছোট অসমাপ্ত ঘর আছে যার সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘বন গবেষণা কার্যালয়’। এই অফিসে কোন কর্মকর্তা বন গবেষণা করতে এলাকাবাসীর নজরে আসেনি। লাউয়াছড়া ফরেস্ট এলাকায় কয়েক বছর পূর্বে আগর গাছ লাগানো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, অনেক গাছ লাগানো হয়েছিল কিন্তু কেউ জানে না এই গাছগুলো পাহাড়ে আছে কি-না। বিগত ২০০৫-২০০৭ সালে যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বন সৃষ্টির জন্য জনগণকে কিছু বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়, যার সকল তথ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির অফিসে সংরক্ষিত আছে। এই কাজের অগ্রগতি মূল্যায়নের সময় এসেছে, কি পরিমাণ গাছ বেঁচে আছে এবং সর্বশেষ অবস্থা জানা দরকার। ভাববার বিষয়, এত কর্মসূচী চলমান অবস্থায় লাউয়াছড়া পাহাড়ে দিন দিন গাছের সংখা কমছে, একটি পাহাড়ে বন রক্ষণাবেক্ষণের যতকিছু প্রয়োজন সবকিছু বিদ্যমান আছে কিন্তু যে পরিমাণ গাছ থাকার কথা তা নেই। বন বিভাগের সকল বন অঞ্চলে বনের পাশে অনেক পতিত উঁচু জমি আছে যা বনের বাফার জোন হিসাবে পরিচিত, এই বাফার জোনের পতিত জমি এক শ্রেণীর স্থানীয় প্রভাবশালীরা বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় বন বিভাগের আওতাভুক্তও পতিত জমি বন বিভাগের মূল ম্যাপ থেকে কেটে বন বিভাগের জমি নয় বলে সার্টিফিকেট দিয়ে প্রভাবশালীদের এই ভূমি তাদের নামে রেকর্ড করার জন্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ৮টি জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন সকল বনাঞ্চলের অবস্থা একই রকম। বিষয়টি কোন মূল্যায়ন কারি দিয়ে মূল্যায়ন করলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। সাতগাঁও, রঘুনন্দন, লাউয়াছড়া ফরেস্টের চতুর্দিকের টিলা ভূমি ও সমতল ভূমি এবং সংলগ্ন হীড বাংলাদেশের দখলে থাকা ৩০০ একর সরকারী ভূমি বেদখল হচ্ছে দিনে দিনে, কিছু দিন পর এই ভূমিতে ঘর বাড়ি তৈরি হলে স্থানীয় বনের উপর নির্ভরশীল গ্রামের জনসাধারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে এই ইস্যুকে জটিল করে তুলবে। এখনি এদের বাধা দিতে হবে। ইউএসআইডির আর্থিক সহায়তায় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বনের উন্নয়নে এই ৮টি জাতীয় উদ্যানের আশপাশের বসবাসরত বনের উপর নির্ভরশীল দরিদ্রজন গোষ্ঠীর উন্নতি ও আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে লাউয়াছড়া এলাকার জনসাধারণকে গরু মোটা তাজাকরণ প্রকল্প নামে প্রায় ৪০ জন গরিব জনগণকে জনপ্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। লাউয়াছড়া বনে বসবাসরত টিপরা জনগোষ্ঠীর গ্রামের প্রবেশ মুখে প্রায় সাত লাখ টাকা দিয়ে একটি পাকা পুল ( ব্রিজ) তৈরি করে দেয়া হয়। লাউয়াছড়ায় ইকো ট্যুরিজমকে উৎসাহ দেয়ার জন্য অত্র বন এবং আশপাশের অনেক যুবকদের ইকোট্যুরিজমের উপর এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বনের উপর নির্ভরশীল কমানোর জন্য মহিলা দল গঠন করে আয় সৃষ্টিকারী প্রকল্প শুরুর জন্য লাখ লাখ টাকা লোন দেয়া হয়। বন পাহারা দেয়ার জন্য ১৪ জনের একটি বন পাহাড় দল গঠন করে ৩ বছর এদের মাসে ২৫০০ টাকা করে বেতন দেয়া হয়। দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্ট আকৃষ্ট করার জন্য লাউয়াছড়া বনের পাশে রাধানগর গ্রামে এই প্রকল্প থেকে একটি কুটির এবং বালিগাঁও এ আরেকটি কুটির তৈরি করে দেয়া হয় যাতে করে ভ্রমণপিপাসু বন এলাকায় থেকে বন্যপ্রাণী ও বনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া প্রতিটি জাতীয় উদ্যানে একটি করে কম্পিউটার দেয়া হয় যাতে করে বন এলাকার যুবক-যুবতীরা দেশী-বিদেশী তথ্য পেতে পারে। তাছাড়া লাউয়াছড়ায় বনের চতুরদিকে সবুজ বেষ্টনী তৈরি এবং বননির্ভর জনগণের অস্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য কয়েক মাইল এলাকায় ছোট গ্রামীণ রাস্তায় স্ট্রিপ প্লেনটেশন পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয়। লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, টেকনাফ, চুনতি, বাহারছড়া জাতীয় উদ্যান, বাঁশখালী ইত্যাদি এলাকায় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক কাজ করা হয়েছে যা সব ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা বলতে পারবেন। তাছাড়া বিদেশী ট্যুরিস্ট আকৃষ্ট করার জন্য লাউয়াছড়াতে একটি তথ্যকেন্দ্র্র প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়। এই লাউয়াছড়া প্রকল্পের সঙ্গে আমি একজন পরামর্শক হিসেবে জড়িত ছিলাম কয়েক বছর। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান কমিটির সভাপতি হিসেবে দুই টার্ম দায়িত্ব পালন করেন। এত আয়োজন, এত কাজ করার পরও আজ পর্যন্ত গাছ চুরি বন্ধ করা যায়নি। এখানে উল্লখ করা প্রয়োজন যে, এই বনাঞ্চলের আশপাশের গ্রামের বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল মানুষের এক সময় পেশা ছিল এই পাহাড় থেকে গাছ চুরি করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা। তাই আশপাশের গ্রামের অনেকের নামে গাছচুরির মামলা এখনও বন আদালতে বিচারাধীন। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে কিন্তু এই মামলার কোন শেষ হয় না। এই মামলায় অনেককে জেল খাটতে হয়েছে, কোর্টে হাজিরা দিতে হয়, উকিলের মাধ্যমে জামিন নিতে হয়। এই মামলা তাদের জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটি মামলায় হাজিরা দিতে গিয়া অনেক টাকা খরচ হয়ে যায় যা তাদের ঘাটতির মধ্যে ফেলে দেয় তাই তারা ওই ঘাটতি পূরণ করতে আবার গাছ চুরি করে এবং আবার মামলায় পরে এতে করে কোন মামলা থেকে বের হতে পারছে না, তাদের যদি এই বন মামলা থকে অব্যাহতি দেয়া হতো এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হতো তা হলে তাদের বিকল্প পেশায় নিয়োজিত করলে এলাকায় গাছ চুরি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। আলোচনা করে কিভাবে এই বিষয়টি সমাধান করা যায় তার পথ খুঁজে বের করে গ্রামবাসীদের মামলার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে আনলে একটা অধ্যায়ের শেষ হতো। এতে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে এবং পাহাড়ও পূর্বের মতো সবুজ বনে ভরে উঠবে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে পুনরুজ্জীবিত করা এখন সময়ের দাবি। যে সমস্ত বনকে ঘিরে জাতীয় উদ্যান গড়ে উঠেছে, সে দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়ার দরকার। কিভাবে সবাইকে সক্রিয় করে বন ব্যবস্থাপনায় আরও গতি আনা যায় এবং গাছ চুরি বন্ধ করা যায়- তা ভাবার সময় এখনই। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×