ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফরিদপুরে উদ্ভাবিত লালমি জনপ্রিয় হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:২০, ১ জুন ২০১৯

 ফরিদপুরে উদ্ভাবিত লালমি জনপ্রিয় হচ্ছে

দেখতে অনেকটা বাঙ্গির মতোই। তবে আছে কিছু পার্থক্য। বাঙ্গির মতো গায়ে শিররেখা নেই। গায়ের রঙ এবং গন্ধও আলাদা। স্বাদেও আছে কিছু পার্থক্য। বাঙ্গি রবি মৌসুমের ফল, পাকতে শুরু করে চৈত্র মাসে। পক্ষান্তরে লালমির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয় হলো শীতের দুই মাস বাদে বছরের যে কেন সময় জমিতে চাষ করা যায়। রমজান মাস সামনে রেখে ফরিদপুরে চাষ করা হয় লালমি। রোপণের ৬০ দিনের মধ্যে এটি পাকে বলে কৃষক টার্গেট করে রমজান মাসের প্রথম দিনে লালমি বাজারজাত করতে। রঙ, স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ হিসাব করে কৃষকই এ ফসলের নাম রেখেছে লালমি। তবে কৃষি বিভাগ এ ফসলের নাম করণসহ অধিক মূল্যায়ন ও উন্নয়নের জন্য শুরু করেছে গবেষণা। ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, লালমি মূলত ফরিদপুরের কৃষকদের উদ্ভাবিত একটি ফসল। এটি জেলার সদরপুর এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয়। তবে সদরপুরের সংলগ্ন নগরকান্দা, ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলার কিছু অঞ্চলে চাষাবাদ হয়। এ বছর ফরিদপুরে ৫৮৪ হেক্টর জমিতে লালমির চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সদরপুরেরই লারমির চাষ করা হয়েছে ৫৬০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে লারমির উৎপাদন হয় ১৫ থেকে ১৬ মে. টন। ধারণা করা হচ্ছে ওই জমিতে লালমি উৎপাদন হবে নয় হাজার মে. টন। এ লালমি বিক্রি করে ৫০ কোটি টাকা আয় হবে। ফরিদপুরের সদরপুর গত প্রায় ১৫ বছর ধরে লালমি চাষ করা শুরু হয়। ওই এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের যাত্রাবাড়ী এলাকার আলিম খাঁ নামে এক কৃষক প্রথমে লালমি, চাষ করেন। তার সাফল্য দেখে অন্য কৃষকরা লালমি চাষে উৎসাহিত হন। বছরের প্রায় যে কোন সময়ে লালমি চাষ করা যায় বলে কৃষক রমজান মাসকে উদ্দেশ্য করে লালমি চাষ করেন। লালমি হালকা পানীয় জাতীয় ফসল এবং সহজে শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এ কারণে সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকার পর সন্ধ্যায় ইফতারির সময় এক গ্লাস লালমির রস শরীরকে সতেজ করে তোলে দ্রুত। বিঘা প্রতি জমিতে চাষাবাদ বাবদ খরচ হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন চাষীরা। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি কৃষকদের। সদরপুরের ভাষাণচর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকার কৃষক মোজাফফর মোল্লা জানান, এবছর তিনি ২৬ শতাংশ জমিতে লালমি চাষ করেছেন। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লাভ হবে তার। নগরকান্দার রামনগর এলাকার কৃষক বদরউদ্দিন প্রামণিক বলেন, এবছর তিনি ৭৫ শতাংশ জমিতে লালমি চাষ করেছেন। গত বছরও সম পরিমাণ জমিতে চাষ করেছিলেন। গত বছর লালমি চাষ করে ৬০ হাজার টাকা আয় করেছিলেন। সদরপুরের নতুন বাজার ও নগরকান্দার গোপালপুর বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে সড়কের দুই পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে লালমি। কৃষক ক্ষেত থেকে লালমি তুলে ঝুড়িতে ভর্তি করে নিয়ে আসছে বাজারে। নারী ও শিশুরা পানি দিয়ে পরম মমতায় প্রতিটি লালমি গা থেকে ধুলা বালি দূর করে পরিষ্কার করছেন। সব মিলিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ওই এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে দেখা গেছে এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে লালমি চাষ করা হয়নি। সদরপুর উপজেলার সবচেয়ে বেশি বড় হাট বসেছে কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কাটাখালী, মটুকচর, নতুন বাজার ও বাঁধানোঘাট এলাকায়। এছাড়াও পিয়াজখালী, আকোটেরচর, কারীরহাট, বিষ্ণুপুরসহ একাধিক জায়গায়ও বসেছে লারমির হাট। এর মধ্যে কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের হাটগুলো সবচেয়ে বড় এবং বেচাকেনা বেশি। কাটাখালীর আব্দুল ওসমান মাতুব্বর (৩৮) জানান, তিনি এ বছর ২ বিঘা জমিতে লালমির চাষ করেছেন, ইতোমধ্যে ক্ষেতের অধিকাংশ লালমি বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশ ভাল লাভ হয়েছে। নতুন বাজার এলাকার বেপারী শাহজাহান মৃধা (৪৯) জানান, প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক লালমি পাঠানো হয় ঢাকায়। ঢাকায় তার সহযোগী ফারুক মৃধার মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বাজারজাত করেন। পাইকারি মহাজন ইদ্রিস হোসেন (৪৫) বলেন, আমরা এখান থেকে কৃষকদের নিকট থেকে লালমি কিনে ঢাকায় পাঠাই। সকাল ও দুপুরে কিনে রাতে ট্রাকযোগে ঢাকার বিভিন্ন আড়তে পৌঁছে দেই। এখানকার চেয়ে ঢাকায় দাম ও বিক্রি ভাল পাওয়া যায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, লালমি বাঙ্গির সাদৃশ্য একটি ফল। ফরিদপুরে উৎপাদিত ১৮টি ফলের মধ্যে আর্থিক বিবেচনায় বাঙ্গি ও লালমির অবস্থান পাঁচ নম্বরে। এটি এই এলাকার কৃষকরাই উৎপন্ন করেছে। তিনি বলেন, তবে আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এ ফসলকে গবেষণা করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে। -অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর থেকে
×