মন্টির মা নেই। ওকে জন্ম দিয়ে মারা যান। ও খালার কাছে মানুষ। খালা ওকে বুকে আগলে রাখেন। খালার ছেলেমেয়ে নেই। খালুও মন্টিকে খুব ভালবাসেন। অফিস থেকে কখনই খালি হাতে ফেরেন না। মন্টির পছন্দের কিছু না কিছু থাকে হাতে। ছবির বই, রং পেন্সিল, মিমি, চকলেট বা খেলনা। মন্টি খালাকে মামণি আর খালুকে বাবান ডাকে। খালাই ওকে শিখিয়েছেন। ও সব চেয়ে খুশি হয় রং পেন্সিল পেলে। ও ছবি আঁকে। ছবি আঁকতে কেউ ওকে শেখায়নি। ও একা একা আঁকিবুঁকি করতে করতে শিখে গেছে। একদিন মামণি তরকারি কুটছিল। মন্টি মামণির পাশে বসে বসে রসুনের খোসা ছিলে দিচ্ছিল। হঠাৎ ওর যেন কী মনে হলো। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। তারপর খাতা কলম নিয়ে এসে মামণিকে বলল,
: একদম নড়বে না কিন্তু, ঠিক যেভাবে আছ সেভাবে থাক
: না নড়লে তরকারি কাটব কি করে?
: তরকারি কাটার দরকার নেই।
: রান্না হবে কি করে, খাবি কি?
: এখন খাব না। ছবি আঁকা হয়ে যাবার পর তুমি তরকারি কাটবে। তারপর রাঁধবে। আমার আজ একটুও ক্ষুধা লাগেনি।
কী আর করা, মামণি গুছিয়ে বসেন। আর মন্টি কাগজের ওপর পেন্সিলের টান টেনে যেতে থাকে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ বসে থেকে মামণির পা ধরে যায়। অধৈর্য হয়ে ওঠেন,
: এবার উঠি। পায়ে ঝিঁঝিঁ লেগে গেল যে
: আর একটু মামণি।
তারপর এক দৌড়ে মন্টি আসে মামণির কাছে। ছবিটা মেলে ধরে। মামণি হা করে তাকিয়ে থাকেন। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
: এই তুই এসব শিখলি কবে, কার কাছ থেকে শিখলি। এযে অবিকল আমাকে এঁকেছিস!
: কারো কাছে না। একা একা শিখেছি মামণি।
: তোকে আমি আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেব। আজ তোর বাবা আসুক।
মামণি বাবার অপেক্ষায় বসে থাকেন। এক মিনিটের জন্যও মন্টির আঁকা ছবিটা হাতছাড়া করেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মামণি বিকেলে নাস্তা বানালেন। মন্টির প্রিয় বোম্বে টোস্ট। মামণি আর মন্টি একসাথে বসে খেল। এরপর মামণি চা বানাতে গেলেন। মন্টি মায়ের পেছন পেছন গেল,
: কিরে পিছে পিছে ঘুরছিস কেন?
: আমি একটু চা খাবো মামণি। আমাকে একটু চা দাও বেশি দুধ আর চিনি দিয়ে।
: বাচ্চাদের চা খেতে নেই
: শুধু আজকে একটু মামণি।
মামণি হাসেন। যত্ন করে চা বানান। তারপর মা ছেলে চা নিয়ে বসেন। চা তখনও শেষ হয়নি। বেল বাজে। মন্টি দরজা খুলতে যায়। মামণি বাধা দেন,
: তুই বস, আমি যাচ্ছি
ক্লান্ত শ্রান্ত বাবান ঘরে ঢুকলেন। নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন বাবান। মামণি বললেন,
: ঘরে পরে যেও। আগে এদিকে এসো
: কেন?
মামণি বাবার হাত ধরে এনে চেয়ারে বসালেন। তারপর মন্টির আঁকা ছবিটা বাবার সামনে মেলে ধরলেন
: দারুণ তো! কে এঁকেছে?
: বলত কে?
: আমি জানব কি করে। আমি খুব ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি বল কে এঁকেছে। এমন সুন্দর পোর্ট্রেট আমি আর দেখিনি। তোমার মুখটা অবিকল হয়েছে ।
: তোমার ছেলে এঁকেছে, তোমার ছেলে!
: কী!
বাবান উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। মন্টির কাছে আসেন।
: তুই এঁকেছিস?
: হ্যাঁ বাবা। তুমি চা নাস্তা খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমি পরে তোমার একটা ছবি এঁকে দেব।
: তাই দিস। কাল আমি ছবিটা অফিসে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলব, আমার এই ছবিটা আমার ছেলে এঁকেছে। আমার ছেলে অনেক গুণী। লেখাপড়ায় যেমন ভাল, তেমনই ভাল ছবি আঁকায়। ব্যবহারেও আমার ছেলের তুলনা হয় না। আর দেখতেও আমার মতো সুন্দর!
মন্টি হাসার আগেই মামণি হেসে ওঠেন। সে হাসির সঙ্গে ওদের দু’জনের হাসি মিশে যায়।
মন্টি বাবানের একটা ছবি এঁকে দেয়। বাবান মন্টির আঁকা ছবিটার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকেন। এই ছবি তার ছেলে মন্টি এঁকেছে। ও এত সুন্দর আঁকতে শিখল কি করে!
দিন কয়েকের মধ্যেই বাবান মন্টিকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে বার বার বলেন,
: সবার আগে কিন্তু লেখাপড়া বাবা। তারপর অন্য কিছু। তুমি আঁকবে, কিন্তু লেখাপড়া বাদ দিয়ে নয়।
আস্তে আস্তে সবাই জেনে যায় মন্টি খুব ভাল পোর্ট্রেট আঁকে। অনেকেই ওর কাছে ছবি আঁকাতে আসে। মন্টি চেষ্টা করে সবার ছবি এঁকে দিতে। মা আজকাল বড্ড বিরক্ত হন। সারাক্ষণ যদি ও মানুষের মুখই আঁকবে তবে পড়বে কখন?
সেদিন স্কুলে যাচ্ছিল মন্টি। স্কুল ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়ায় ও। ওর বয়সী একটা ছেলে জুতো সেলাই করছে। প্রচ- গরম আর প্রখর রোদে ওর শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম নেমে পায়ের পাশে একটা জলের কু-লী তৈরি করেছে। মন্টি ওর পাশে দাঁড়ায়। ছেলেটা মুখ তুলে তাকায়,
: জুতা সেলাই করাবেন?
: না
: তবে রং?
: না
: তাহলে?
: তোমার একটা ছবি আঁকতে চাই। আমি মানুষ দেখেই আঁকতে পারি।
: আপনি ছবি আঁকলে আমার লাভ কি। বরং আমার সময় নষ্ট হবে, কাজের ক্ষতি হবে। আমার এই ছেঁড়া কাপড় দেখে ভদ্রলোকরা হাসবে। সামনে ঈদ, আয় বাড়ানো দরকার।
ও কাজে মন দেয়।
মন্টি বাড়ি আসতেই মামলি ছুটে আসেন।
: শোন শোন ভাল খবর আছে।
মন্টি আগ্রহ দেখায় না। গুম হয়ে বসে থাকে। মা অবাক হয়ে বলেন,
: কি হয়েছে? মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে?
জবাব দেয় না মন্টি।
: কিরে বলছিস না কেন, কি হয়েছে?
এবারও জবার দেয় না মন্টি।
মা এবার ওর গা ঘেঁষে বসেন। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বলেন,
: তোর বাবানের প্রমোশন হয়েছে বুঝলি। কতদিন ধরে আমরা এই প্রমোশনের আশায় ছিলাম। বাবান বলেছে এবার ঈদে তোর একস্ট্রা বাজেট। যা চাইবি তাই পাবি। কি কি চাই বল?
: কিছু চাই না।
: মানে, হয়েছে কি?
এবার রাগে ফেটে পড়ে মন্টি।
: হয়েছে অনেক কিছু মামণি, অনেক কিছু। আমি ডিম খাই, দুধ খাই, বোম্বে টোস্ট খাই। ভাল স্কুলে পড়ি। আর ওই স্কুলের সামনে আমার বয়সী ছেলেটা দিনরাত জুতো সেলাই করে। ওর জামাটা অনেক ছেঁড়া, অনেক ফুটো। কেন মামণি, কেন?
মামণি এসে মন্টিকে জড়িয়ে ধরেন। মন্টি কাঁদতে থাকে। মামণি ওর চোখের জল মুছাতে মুছাতে বলেন,
: এই বৈষম্য খুবই খারাপ। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো আমি করতে পারব না বাবা। তবে এবার ঈদে তোদের দু’জনকে, মানে তোকে আর ওই ছেলেটাকে আমি এক পোশাক কিনে দিতে পারব। এক পোশাক পরে তোরা নামাজ পড়তে যাবি। তারপর বাসায় এসে একসঙ্গে সেমাই খাবি। আমি নিজে গিয়ে ওকে পোশাক দিয়ে আসব।
: ও নেবে কেন? যদি দান মনে করে?
: নেবে বাবা। মা আদর করে দিলে সবাই নেয়। মায়ের দেয়া জিনিসে যে মমতা মেশানো থাকে।
মন্টি মায়ের বুকে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে ভাবে, এক রকম পোশাক পরলে ওদের দু’জনকে কেমন দেখাবে। ভাবে, ছেলেটা এবার নিশ্চয়ই ওর বন্ধু হবে। ওর ছবি আঁকতে দেবে!
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার