ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এদের মাত্র দশ শতাংশেরও কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে

দেশে প্রতিবছর ১৩ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১ জুন ২০১৯

দেশে প্রতিবছর ১৩ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ ক্যান্সারাক্রান্ত শিশু রোগী চিকিৎসার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। দেশে যে হারে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, তার ১০ শতাংশেরও কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে। বাকি ৯০ শতাংশ ক্যান্সারাক্রান্ত শিশু যথাযথ চিকিৎসার আওতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দেশে শিশু ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার চারটিসহ মোট দশটি সরকারী হাসপাতালে শিশু ক্যান্সার বিভাগ চালু আছে। প্রতিবছর যত শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও অবকাঠামো নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শিশু ক্যান্সারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় সম্ভব জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের মতে, যেভাবে শিশুদের মধ্যে ক্যান্সার বাড়ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বছর কয়েক আগেও দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের ৯০ শতাংশই মারা যেত। অথচ ওই সময়ে উন্নত রাষ্ট্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ শিশুই চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ’১২ সালের আগে দেশে কত সংখ্যক ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু রয়েছে তার কোন তথ্য ছিল না। ’১২ সালে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে আমেরিকা ও কানাডা ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভাগ চালু হয়। সেই থেকে ওই দুই কলেজ হাসপাতালের শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্সরা নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি, এর পরে ব্রেন টিউমার, বোন টিউমার ইত্যাদি। ’১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশনকৃত শিশু ক্যান্সার রোগীর অধিকাংশ এখনও এ বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, চিকিৎসায় ৫৮ শতাংশ রোগী সুস্থ হলেও বাকি ৪২ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। যদিও আশার বিষয় শিশু ক্যান্সারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা সম্ভব। পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সমীক্ষায় যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা বেশ আশ্চর্যজনক। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ বংশগত সূত্রে জিনের মাধ্যমে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বাকি প্রায় ৯৫ শতাংশই জন্ম পরবর্তীকালে পারিপার্শ্বিক কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা শতকরা ৬০ শতাংশেরও উপরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা (শিশু ক্যান্সারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) ছাড়া ক্যান্সার ধরতেই পারছেন না। এর কারণ শিশু ক্যান্সারের উপসর্গ ও লক্ষণ আলাদা, কখনও বা জ্বর, কখনও দেহে বিশেষ চিহ্ন বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া ইত্যাদি পৃথক উপসর্গ থেকে ক্যান্সার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, জিনগত ক্যান্সার ছাড়া নগরায়নের পরোক্ষ প্রভাবেই শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের ঘটনা বাড়ছে। ভাইরাস, দূষণ আর বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি ক্যান্সারের মূল কারণ। শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, অতি মাত্রায় শিল্পায়ন, শিশুদের শরীরে ক্যান্সার জন্ম দিচ্ছে। আমেরিকা আর কানাডায় শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ ক্যান্সার। ইউরোপে বছরে প্রায় ৭ শতাংশ শিশু ক্যান্সারে মারা যায়। এসব তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, নগরায়ন আর শিশু ক্যান্সারের বৃদ্ধির মধ্যে সমানুপাতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোয়াররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যান্সার একটি জটিল রোগ, যার কোন নির্দিষ্ট বয়স সীমা নেই। এখনও অনেকে মনে করেন ক্যান্সার বয়স্কদের রোগ, শিশুদের ক্যান্সার হয় না, এটা ভুল ধারণা। এটি শুধুমাত্র বয়স্কদের নয়, বরং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যে কোন বয়সেই ক্যান্সার হতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশই ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ শিশু কিশোর। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে এবারও আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতিবছর দেশে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন অকালে ঝরে পড়ছে। সঠিক চিকিৎসায় শিশুদের অনেক ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য। অবশ্য বাংলাদেশসহ অনেক দেশে সংক্রামক রোগে শিশু মৃত্যুরহার কম। এদিকে, ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যান্সারের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর দুই লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৮০ শতাংশই মধ্য আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে ক্যান্সার আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার মাত্র ৫ ভাগ, উন্নত দেশগুলোতে এই হার ৮০ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতিবছর শনাক্ত হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার নতুন শিশু ক্যান্সার রোগী। দেশে ক্যান্সার রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যাও কম। চিকিৎসাও খুব ব্যয়বহুল। ফলে সব ক্যান্সার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, দেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতিবছর অন্তত আড়াই লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের চার থেকে পাঁচ শতাংশই শিশু। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৩ হাজার শিশু। যদি শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত ধরা হয় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ১২ থেকে ১৮ হাজার।
×